মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

ভয়ঙ্কর খুনীর তিন সশস্ত্র দেহরক্ষী

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২  

 

# সকল মাদকের আস্তানার নিয়ন্ত্রক বজলু নিজে



রাজধানী থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দুরে রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তি। অপরাধীদের অভয়ারণ্য চনপাড়া বস্তির ৮০ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত। অপরাধীদের বিচরনক্ষেত্র চনপাড়া দিনেদিনে হয়ে উঠেছে মাদকের অভয়ারণ্য। আর এই মাদকের নিয়ন্ত্রণ করেই কাঁচা টাকার মালিক বনেছেন কয়েকজন।

 

 

 

এ কারণেই বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত কয়েক বছরে আলোচিত ১৫টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। হত্যাকান্ডের শিকার বেশির ভাগই ছিলেন এই বস্তির নিয়ন্ত্রক। বর্তমানে এই বস্তির বিশাল মাদকের হাটের নিয়ন্ত্রক সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা বজলু মেম্বার। বজলু মেম্বার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য।

 

 

 

অভিযোগ রয়েছে, চনপাড়া বস্তির পুরো মাদকের সিন্ডিকেট তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। কয়েক শ’ মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রতিমাসে মাসোহারা নিয়েই রাতারাতি বনে গেছেন কয়েক'শ কোটি টাকার মালিক। মাত্র ১০ বছর আগে চনপাড়া বাজারে একটি চালের দোকান ছিল। তারও আগে ছিচকে চোর থেকে হয়েছিলেন বাসের হেলপার।

 

 

 

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে চনপাড়া বস্তির মাদকসহ সকল অবৈধ কাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় সে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাতারাতি ফুলে ফেঁপে হয়ে গেলেন শতকোটি টাকার মালিক। টাকার প্রভাবে পরপর দুবার নির্বাচিত হন ইউপি সদস্যও।

 

 

 

আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা আর বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীকের সাথে গড়ে তোলেন সখ্যতা। মন্ত্রীপুত্র গোলাম মর্তুজা পাপ্পার সাথেও ঘনিষ্টতা রয়েছে তার। অভিযোগ রয়েছে, চনপাড়া বস্তির মাদকের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে যতগুলো হত্যাকান্ড ঘটেছে-প্রায় সবগুলোই পেছনেই বজলুর রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসাজশ।

 

 

 

তার নামে রূপগঞ্জ থানায় একাধিক হত্যাসহ রয়েছে একডজন মামলা। কোন ব্যবসা বাণিজ্য না করেও এই ভয়ংকর অপরাধী শত কোটি টাকার মালিক। চলাফেরা করেন তিনজন সস্বস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে। সম্প্রতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদও পেয়েছেন কুখ্যাত এই অপরাধী।

 


সুত্রমতে, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু দেশের নদীভাঙ্গা আর ভবঘুরে আশ্রয়হীন মানুষকে রাজধানীর পাশে ওয়াসার ১২৬ একর জমিতে পূর্ণবাসন করেন। এসব ভবঘুরে মানুষ একসময় রাজধানীতে দিনমজুর শ্রমিক পরিবহন চালকসহ বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করতো।বিএনপি আমলে এই বস্তি থেকে ভাড়াটে সন্ত্রাসী নিয়ে খুন করানো হয় উপজেলা বিএনপি নেতা রাসেল ভূইয়াকে।

 

 

 

এরপর আলোচনায় উঠে আসে চনপাড়া বস্তির নাম। সেসময় রাজধানীর ভয়ংকর অপরাধীরা অপরাধ কর্মকান্ড ঘটিয়ে বস্তিতে আশ্রয় নিতেন। ৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় নির্বাচনে বস্তির বাসিন্দাদের ভোটাধিকার না থাকলেও সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ হয়। তখন রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন চনপাড়ার মানুষ।

 

 

 

সেসময় চনপাড়ার ছিচকে চোর আর বাসের হেলপার হিসেবে পরিচিত বজলু চনপাড়া আওয়ামী লীগ নেতা আবু তাহেরের চা এনে দেবার কাজ করতেন। পরবর্তীতে চতুর বজলু বস্তির আওয়ামীলীগে সম্পৃক্ত হন। ২০০৩ সালে রূপগঞ্জের সাবেক এমপি জেনারেল শফিউল্লাহর বিরুদ্ধে অনাস্থা এনে ঝাড়ু জুতা মিছিল করে আলোচনায় আসে বজলু।

 

 

 

এক পর্যায়ে সেখানকার আওয়ামী লীগের সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন। ২০০৬ সালে সামরিক শাসন আমলে বস্তি থেকে ভাড়াটে লোক এনে রূপগঞ্জ ও রাজধানীতে মিটিং-মিছিল-পিকেটিং আর নৈরাজ্য কর্মকান্ডের কারণে কদর বেড়ে যায় এই অপরাধীর। সেসময় ১১টি মামলা নিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয় বজলু।

 

 

 

পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় এমপি গাজীর আর্শীবাদে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। বস্তির মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, প্লট দখল, জিম্মি করে টাকা উদ্ধার, পানির ব্যবসা, উন্নয়ন কাজ, ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি, নৌকার ঘাট আর বাজার নিয়ন্ত্রন, পরিবহন নিয়ন্ত্রন, সালিশী বিচারের নামে ব্যবসা, পানির ব্যবসা থেকে শুরু করে সকল কাজ বৈধ অবৈধ কাজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন বজলু।

 

 

 

এরমধ্যে সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস বস্তি থেকে ভাসমান মানুষকে উচ্ছেদ করে পুনরায় সে প্লট বিক্রি; আর মাদক ব্যবসা থেকে। বজলু নিজে, তার দুই ভাই হাসান আর বোতল মিজু, মেয়ে, মেয়ের জামাই ও স্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই মাদকের ডিলার। গত ১৪ বছরে যারাই চনপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করেছে তারাই বিভিন্নভাবে হত্যার শিকার হয়েছে।

 

 

 

এরমধ্যে আলোচিত হত্যাকান্ডর মধ্যে রয়েছে চানমিয়া, ইউপি সদস্য বিউটি আক্তার কুট্টি ও তার স্বামী হাসান মুহুরী, ফিরোজ সরকার, ফারুক মিয়া। পুলিশের এএসআই হানিফ মিয়া, ফালান মিয়া, আব্দুর রহমান, খোরশেদ মিয়া, মনির হোসেন, আসলাম হোসেন, আনোয়ার, সজল আর সামসু হত্যায় রয়েছে বজলুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ।

 

 

 

স্থানীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার পাবার পর  ২০১৬ সালে এমপি গাজীর আর্শীবাদে বজলু প্রথমবারের মতো ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ২০২২ সালের ইউপি নির্বাচনে দ্বিতীয়বার তাকে একই উপঢৌকন দেন এমপি। ২৩ বছর পর গঠন হওয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের ঘরোয়া কমিটিতেও তাকে করা হয় সদস্য।

 

 


মাদকের অভয়ারণ্য চনপাড়া বস্তিতে মাদকের স্পট রয়েছে একশ’র বেশি। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন বলেছেন, চনপাড়ায় মাদকের ব্যবসা হয় কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, মদ, গাঁজা বিক্রির জন্য পৃথক সিন্ডিকেট রয়েছে। কেউ কারও ব্যবসায় নাক গলাবে না- এটাই এখানকার অলিখিত নিয়ম।

 

 

 

নিয়ম ভাঙলেই বাধে সংঘর্ষ, খুন কিংবা পুলিশকে তথ্য দিয়ে ধরিয়ে দেয়া। চনপাড়া বস্তিতে সড়কে ঢোকার একটি মাত্র পথ, বাকি ৩ দিকে নদী। ফলে সহজেই মাদক আনা নেয়া এবং পুলিশের চোখ ফাঁকি দেয়া সম্ভব। প্রতিটি সিন্ডিকেটের একটি বা দু’টি করে ওয়াচ পার্টি থাকে। এদের কাজ হচ্ছে পোশাকে বা সাদা পোশাকের পুলিশ-র‌্যাব দেখলেই সতর্ক করে দেয়া।

 

 

 

একটি গ্রূপ খুচরা বিক্রি করে থাকে, যারা এক স্থানে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সূত্র জানায়, সিন্ডিকেটে কয়েকশ’ নারী সদস্যও রয়েছে-যারা সরাসরি টেকনাফ থেকে কনডমে ভরে গোপনাঙ্গে করে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে চনপাড়ায়। কখনও মাদক ব্যবসায় ব্যবহার করা হচ্ছে বেদে বহর, কখনও লবণবাহী সাম্পান আবার সিমেন্টের ক্লিংকারবাহী কার্গো জাহাজ। চনপাড়া এলাকার সবচেয়ে বড় ইয়াবার ডিলার রয়েছে। তিনি মিয়ানমার থেকে ইয়াবা তৈরির ডাইস কিনে এনে ইয়াবার কারখানাও বসিয়েছেন।

 



সকল মাদকের আস্তানার নিয়ন্ত্রক বজলু নিজে। বজলুর মেয়ের জামাই রিপন, ভাতিজি জামাই শাওন, পুত্রা রেহান মিয়া, শ্যালক জাকির হোসেন, শাহীন, রাজা ও শাওন মাদকের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন ও মাসোহারা তুলেন। ৪০ টি ইয়াবার আস্তানায় ইয়াবা বিক্রি করতে হয় বজলুর মেয়ে রুমার কাছ থেকে নিয়ে।

 

 

 

স্পটগুলো থেকে সপ্তাহে আবার ১৫ থেকে ৩০ হাজার পর্যন্ত বখরা আদায় করা হয়। এসব বখরা আদায়ের দায়িত্বে রয়েছেন রাজা, সিটি শাহিন, শাওন ও তাদের গ্রূপের দূধর্ষ সন্ত্রাসীরা। বজলুর নিয়ন্ত্রনে বস্তিতে রয়েছে শতাধিক খয়ের পার্টি। এদের তদারকি করে বজলুর স্ত্রী ও শ্যালক জাকির হোসেন।

 

 

প্রতিটি খয়ের পার্টির কাছ থেকে ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত সপ্তাহে চাঁদা নেয়া হয়। এছাড়া জুয়ার স্পর্ট রয়েছে ২৫টিরও অধিক।মাদক কারবার ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্র বেচাকেনাও এবং ভাড়া দেয়া হয় বস্তিতে।

 



এসব অপরাধ কর্মকান্ড করেও বজলু চনপাড়া বস্তিতে ১৭টি প্লট, রাজধানীর ডেমড়া থানার হাজীনগরে ৫ তলা বাড়ী, বনশ্রী, রামপুরায় দুটি ফ্ল্যাট এবং জুরাইনের হাসনাবাদে দুটি দুই তলা বাড়ী কিনেছেন। তাছাড়া রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁ থানার বিভিন্ন এলাকায় নামে বেনামে রয়েছে অসংখ্য জমি।

 

 


সবচেয়ে আতংকের বিষয় কোন ধরনের বৈধ ব্যবসা না থাকলেও বজলুর রয়েছে সশস্ত্র তিনজন দেহরক্ষী। এসব দেহরক্ষীরা জোর করে মানুষকে তুলে নিয়ে বজলুর ৬ নাম্বারের কনসার্ল স্কুলের টর্চার সেলে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে। তার নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরাও।

 

 

 

কায়েতপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা তার নির্যাতনে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সহ-সভাপতি খন্দকার আবুল বাশার টুকু, আওয়ামীলীগ নেতা মনির হোসেন মেম্বার, ছাত্রলীগ নেতা আশরাফুল আলম ভুইয়া জেমিন, আবু বক্কর, যুবলীগ নেতা সেলিমসহ শত শত আওয়ামীলীগের লোক তার অত্যাচারে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

 

 

কোন আয়কর প্রদান ব্যতিত একজন অপরাধী কিভাবে তিনজন গ্যানম্যান বডিগার্ড হিসাবে রাখতে পারে, এই বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার জনগণ।

 



তবে বস্তির নিয়ন্ত্রণ ও মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন বজলু মেম্বার। তিনি বলেন, ‘আমি বারবার নির্বাচিত ইউপি সদস্য। মাদকের সাথে জড়িত থাকলে মানুষ আমাকে ভোট দিতো? কোন হত্যাকান্ডের সাথেও আমি জড়িত না। মিথ্যা আর ষড়যন্ত্র মূলক মামলায় আমাকে বারবার আসামী করা হয়।’

 



এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সহকারী পুলিশ সুপার মো. আবির হোসেন বলেন, ‘চনপাড়া বস্তিতে মাদকের ভয়াবহতা এখন কমে এসেছে। বজলু ওই এলাকার মেম্বার আর আওয়ামীলীগের রাজনীতি করে। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা গুলোতে সে বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। গ্যানম্যানের অনুমতি প্রদানের দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। সেটা তিনি নিয়েছেন কিনা সে ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই। তবে যদি কোন অপরাধে তার সংশ্লিষ্টতা থাকে তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ এন.এইচ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর