শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ভয়াবহ দুর্ঘটনায় তিনজনের প্রাণহানি

লতিফ রানা

প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১  

গতকাল সন্ধ্যায় শহরের ১নং রেলগেট এলাকায় আনন্দ পরিবহনের একটি বাসের সাথে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জমুখী ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। ছবি তুলেছেন আল-আমিন তুষার।

গতকাল সন্ধ্যায় শহরের ১নং রেলগেট এলাকায় আনন্দ পরিবহনের একটি বাসের সাথে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জমুখী ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। ছবি তুলেছেন আল-আমিন তুষার।

# রেলগেটে ট্রেনের সাথে বাসের সংঘর্ষ
# ট্রেন এলেও ব্যারিয়ার পড়েনি
# রেল লাইনের উপর বাস রেখে পালান চালক
# ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি : ডিসি

 

শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ততম এলাকা ১ নং রেলগেট এলাকায় ট্রেনের সাথে আনন্দ পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব: ১১-৪৩৭৪) সংঘর্ষে তিন জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ জন। এদের মধ্যে চারজনের অবস্থা খুবই গুরুতর বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। 

 

নিহতদের দুইজন পুরুষের বয়স ৪৫-৫৫ বছরের মধ্যে হবে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। আরেক শিশুর বয়স আনুমানিক দশ বছর। দুর্ঘটনায় তার বা পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পা বিচ্ছিন্ন অবস্থাতেই প্রথমে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল (ভিক্টোরিয়া) হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এই দুর্ঘটনায় দশজন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসেন। তাদের মধ্যে সাতজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন,  নুরু (৪০), কাদের মোল্লা (৩৫), মেজান মিয়া (৬৫), মনা, মনির (২৬), শাকিল (১২), আমেনা বেগম (৩৫)। অজ্ঞাত আরও তিনজন এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সাবিনা ইয়াসমিন  জানান, গুরুতর অবস্থায় তিনজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং একজনকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) পাঠানো হয়েছে।



এদিকে দুর্ঘটনার ঘটনায় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে যুগের চিন্তাকে জানান জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাইন বিল্লাহ। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার ঘটনায় ‘অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোসাম্মৎ রহিমা আক্তারকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’


 
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, রোববার সন্ধ্যার দিকে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ উদ্দেশ্যে ট্রেনটি ছেড়ে আসলে আনুমানিক সোয়া ছয়টার দিকে শহরের অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা ১ নং রেল ক্রসিংয়ে থাকা একটি আনন্দ পরিবহনকে সজোরে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যায়। এই ঘটনায় কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ জন আহত হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। তবে এদের মধ্যে চারজনের অবস্থা খুবই গুরুতর বলে জানান তারা।
 


ঘটনায় সময় সেখানে উপস্থিত থাকা একাধিক ব্যক্তি জানান, সন্ধ্যা ছোয়া ছয়টার দিকে ঢাকা থেকে ট্রেনটি খুবই দ্রুত গতিতে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় ট্রেন স্টেশনের দিকে যাওয়ার সময় সেখানে রেল লাইনের উপর দাড়িয়ে থাকা আনন্দ পরিবহনের একটি বাসকে ধাক্কা দিলে প্রচন্ড শব্দে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরী হয় এবং বাসটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। এ সময় বাসের ভেতর থাকা দুই যাত্রী নিহত হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায় আরো একজন। রাস্তায় যানজট থাকায় হুইসেল শোনার সাথে সাথে বাসটি সামনে বা পেছনে নেয়া সম্ভব হয়নি।


এই ঘটনায় মারা যাওয়া দুই পুরুষের মরদেহ বাসের নিচ থেকে উদ্ধার করেছেন বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার হামিদুর রহমান। আহতদের মধ্য থেকে তিনজনের সাথে কথা হয়েছে। তাদের তিনজনই লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নাশতা খেতে আসা পোশাক শ্রমিক আমেনাও লাইনের একপাশে দাঁড়ানো ছিলেন। ঘটনার সময় রেললাইনের পাশে থাকা একটি আখের রস বের করার যন্ত্র তার শরীরের উপর পড়ে। এই ঘটনায় হতাহতদের অন্য কেউ বাসের যাত্রী ছিলেন কিনা তা নিশ্চিত করে জানা যায়নি। তবে বাসের চালক ও তার সহযোগী পালিয়ে গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী।
 


১নং গেট এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীসহ সেখানকার একাধিক পথচারী জানায়, নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় ট্রেন স্টেশনটি খুব কাছাকাছি অবস্থায় থাকলেও ট্রেনটি খুবই দ্রুত গতিতে আসছিল। সে সময় ট্রেনের সিগন্যাল বার উঠানো ছিল এবং রেল লাইনের উপরে আনন্দ পরিবহনের বাসটি অবস্থান করছিল। তারা আরো অভিযোগ করে বলেন, হিসেব মতে ট্রেনটি যখন চাষাঢ়া রেল ষ্টেশনে আসে তখন থেকেই ট্রেনের গতি কমিয়ে দেয়ার কথা। কেননা, চাষাঢ়া থেকে কেন্দ্রীয় স্টেশনের দুরত্ব একেবারেই অল্প। তাছাড়া এই অল্প জায়গার মধ্যেই রয়েছে কমপক্ষে ছয়টি (চাষাঢ়া, বালুর মাঠ, গলাচিপা, নন্দীপাড়া, ২নং রেলগেট ও ১নং রেলগেট) গুরুত্বপূর্ণ রেলগেট। একটি  রেলগেট থেকে আরেকটির দুরত্ব খুব একটা বেশী না। তাছাড়া প্রধান শহরের গুরুত্বপূর্ণ এই অংশে রেল লাইনের পাশ ঘেঁষে আছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাজার ও ভাসমান হকারের অবস্থান। এর মধ্যে ১নং রেলগেট এলাকার খুব কাছাকাছি রেলস্টেশনটি ছাড়াও রয়েছে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, লঞ্চ-টার্মিনাল। এর দক্ষিণ দিকে নারায়ণগঞ্জের অন্যতম ব্যবসায়িক এলাকা টানবাজার। উত্তর দিকে খুব কাছাকাছি নারায়ণগঞ্জের অন্যতম ব্যস্ত কাঁচাবাজার দ্বিগুবাবুর বাজার এবং অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জ কলেজ ও নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুল। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো এই রেলগেটের আশপাশ এলাকার রাস্তাগুলো হকারদের ভাসমান দখলে থাকায় যানজট নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকে। তাই এখানে প্রায় সব সময়ই রেললাইনের উপর কোন না কোন গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাই এই এলাকার এই নিত্য চিত্র অবলোকন করার পর এবং এখানে বিভিন্ন সময় দুর্ঘটনা ঘটার পরও কেন রেল চালক এতটুকু স্থান সজোরে চালিয়ে নিয়ে আসে তা এখানকার মানুষজনের বোধগর্ম নয় বলে জানান স্থানীয় একাধিক ব্যাক্তি।


 
দুর্ঘটনা ও অভিযোগের বিষয়ে কথা বললে নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশন মাস্টার চৌধুরী মোহাম্মদ আকতার হায়দার বলেন, আমি ঘটনা স্থলে না থাকায় আসলেই কি হয়েছে তা বলতে পারবো না। ট্রেনটি দ্রুত গতিতে আসছিল কি না বা সেখানে গেট এর সিগন্যাল বার নামানো ছিল না এমনকি সেখানে গেট উপস্থিত ছিল কি না তাও আমি সঠিকভাবে এই মুহুর্ত্বে বলতে পারবো না। তিনি আরো জানান, এখানে তিনজন গেটম্যান তিনটি সিফটে আট ঘন্টা করে ডিউটিতে থাকার কথা। যে সময় দুর্ঘটনাটি ঘটে সে সময় সেখানে গেটম্যান মো. হানিফ এর ডিউটি ছিল। ঘটনাটি যাচাই বাছাই করার পর বিস্তারিত বলতে পারবো।


 
এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহজামান বলেন, ঘটনাটি ঘটার সংবাদ পেয়ে সাথে সাথে এখানে চলে এসেছি। এখান থেকে আমরা দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছি। আরে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানতে  পেরেছি। তবে গেটম্যান উপস্থিত ছিল কি না, বা গেট বার নামানো ছিল  কি না এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার পর সঠিকভাবে বলা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। বাসটি রেল লাইনের উপর ছিল কি না, বা ট্রেনটি দ্রুত গতিতে ছিল কি না তা যাঁচাই বাঁছাই করে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।
 

এই বিভাগের আরো খবর