শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মসজিদের জায়গা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াছিনের প্রতারণা

রাকিবুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৪ জানুয়ারি ২০২৩  

 

# জাল দলিলের সত্যতা পেয়ে আদালতে প্রতিবেদন
# কান্দাপাড়া মসিজদের জায়গা থেকে ১ কোটি টাকা নেয়ার অভিযোগ

 

‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ কথাটা যেন এখন আর খাটছেনা নানা অনিয়মের হোতাদের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের সভাপতি ও নাসিক ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক মামলা হয়।

 

 

সেই মামলায় তার বিরুদ্ধে গত ২৩ ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বিষয়টি নিশ্চিত করেন দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন।

 

 

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা গত বছরের ২৩ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আর কত দরকার। কত টাকা হলে আপনারা দুর্নীতি অনিয়ম করা বন্ধ করবেন। এবার মানুষের জন্য কাজ করেন। প্রতিটি মানুষের কাছে গিয়ে ভোট চেয়ে তাদের মন জয় করুন।

 

 

এদিকে তার সেই বক্তব্যের রেশ শেষ হতে না হতেই ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতি, প্রতারণার অভিযোগ উঠছে। এই তালিকায় নাম পড়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিন মিয়ারও। যদিও তালিকার অনেকের নামে দুদক থেকে শুরু করে প্রতারণার মামলা পর্যন্ত হয়েছে।

 

 

তার মাঝে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইয়াছিনের বিরুদ্ধে প্রতারণা, মসিজদের জায়গার দলিল জালিয়াতির মামলা হয়েছে বলে জানান স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি। অথচ তাকে সর্বদা মাথায় টুপি পড়ে থাকতে দেখেন এলাকাবাসী। কেউ কেউ বলেন তিনি সব সময় লম্বা পাঞ্জাবি পড়েন। আবার নামাজও পড়েন। দেখতে একজন আমলদার পরহেজগার ব্যক্তি মনে হবে।

 

 

তিনি যে ক্ষমতাসীন দলের পদের প্রভাব বিস্তার করে মসিজদের জায়গা নিয়ে প্রতারণা করবে তা কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জ মিতালী মার্কেটের মসজিদের ওয়াকফকৃত জায়গা নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়াসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে বন্দর থানায় মামলা হয়। যার  কোর্ট পিটিশন মামলা নম্বর ২৯/২২।

 

 

কোর্টের স্মারক নং ৫১৯৩(৪)। এই মামলার ৪ নম্বর আসামী সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াছিন মিয়া। ৪২০/৪১৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৬৯/ ১০৯/৩৪ ধারা পেনালকোড ১৮৬০ পরস্পর যোগসাজসে প্রতারণার উদ্দেশ্যে অন্যের রূপ ধারণ করে মূল্যবান জাল দলিল সৃষ্টি করে খাঁটি হিসেবে ব্যবহার করাসহ জালিয়াতি, প্রতারণার ও দুষ্কর্মের সহায়তা করার অপরাধে এই মামলা হয় বলে এজহারে উল্লেখ করা হয় হয়।  

 



তন্মধ্যে ৪২০ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ প্রতারণা বা ঠকবাজির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি হস্তান্তর করতে সেই ব্যক্তিকে, বা সেই ব্যক্তির মূল্যবান বস্তু (valuable securitz) / সেই মূল্যবান বস্তুর কিছুটা বা পুরোটা পরিবর্তন বা ধ্বংস করতে অসাধুভাবে চালনায় করে, তবে তা প্রতারণার দায়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়।

 



এছাড়া ৪৬৮ ধারায় উল্লেখ্য রয়েছে, প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতি করা। যদি কোন ব্যক্তি প্রতারণা করবার উদ্দশ্যে কোন জাল দলিল প্রণয়ন বা জালিয়াতি করে, তবে উক্ত ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং অথর্দন্ডে ও দন্ডিত হবে।

 

 

বিশ্লেষণ: এই ধারায় বর্ণিত অপরাধটি গুরুতর ধরণের অপরাধ। কোন ব্যক্তি প্রতারণা করবার উদ্দেশ্যে যদি দলিল জাল করে তাহলে ৪৬৮ ধারায় অপরাধ সম্পন্ন হবে। বাস্তবে প্রতারণা না করলেও দণ্ড দেওয়া যাবে। প্রতারণার উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিপ্রায়ে জাল দলিল সৃষ্টি করবার অপরাধে দন্ডিত হবে। ক্ষেত্র বিশেষে আসামীর দণ্ড পরিবর্তন হতে পারে ।

 



মামলার বাদী জয়নাল আবেদিন ফারুক এজহারে উল্লেখ করেন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন খোর্দ্দঘোষপাড়া মৌজাস্থিত সিএস ৮৫,এসএ ৯৫ ও আর এস ১৬ নং খতিয়ান ভুক্ত সিএস ২৩০ এবং আর এস ২৯২ নং দাগের মরহুম আবদুস সাত্তার কামালের ছেলে আফছার আহম্মেদ পৈত্রিক ওয়ারিশ সূত্রে মালিক হয়ে ১৯৯৬ সনের ১৬ অক্টোবর সিদ্ধিরগঞ্জ মিতালি মার্কেট জামে মসজিদের নামে ৬৪ শতাংশ হইতে ২৯ শতাংশ জায়গা ওয়াকফ করিয়া দেন। যার দলিল নং ৩৯২৮।

 

 

পরবর্তিতে ১৯৯৮ সনের ১৮ আগষ্ট এই সম্পত্তি বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসকের অফিস ওয়াকফ ভবন ৪ নিউ ইস্কাটন ঢাকা মিতালি মার্কেট জামে মসজিদের নাম ওয়াকফ এস্টেট তালিকা ভুক্ত হয়। যাহার ইসি নং-১৮৬০২। এই মসিজেদে পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ আদায় হয়।

 



তিনি আরও উল্লেখ্য করেন, সিদ্ধিরগঞ্জ খোর্দ্দঘোষপাড়া মৌজাস্থিত সিএস ও এস এ ২৩০ দাগ,আর এস দাগ ২৯২ দাগের ২৯ শতাংশ জায়গা মিতালি মার্কেট জামে মসজিদের নামে ওয়াকফকৃত সম্পত্তি মামলার ৪ নং আসামী ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি ইয়াছিন মিয়া ওই মিতালি মার্কেট জামে মসজিদের মোতায়াল্লি রূপ ধারণ করে মামলার ১ থেকে ১০ নম্বর আসামী পরস্পর আত্মীয় বা একই বংশের না হয়ে পরস্পর যোগসাজসে ওয়াকফকৃত সম্পত্তি অসৎ উদ্দেশ্যে আত্মসাত করার লক্ষে জাল দলিল জালিয়াতির মাধ্যমে আসামীরা একে অপরের সহযোগিতায় ২০২২ সনের ৯ ফেব্রুয়ারি আপোষ নামার চুক্তিপত্র দলিল করেন। যার দলিল নম্বর ১২৫৬।

 

 

আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াছিন সহ মামলার অন্যান্য আসামীরা প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি খাস ১ নং খতিয়ানের পরিবর্তে ২৫ নং খতিয়ান দেখিয়ে ওয়াকফকৃত সম্পত্তি  আত্মসাৎ করেন। বাদি পক্ষ ২০২২ সনের ২৫ মে তা অবগত হন। পরে তার সার্ঠিফাই কপি তুলে বন্দর থানায় অভিযোগ করেন। যা পরবর্তিতে মামলা হয়।

 



বন্দর থানার পুলিশ পরিদর্শ মো. রেজাউল করিম এই মামলার তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ্য করে বলেন, মামলার এজহার নামীয় আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করি। আসামীগণ আদালত থেকে জামিনে আছেন। আসামীদের ঠিকানা যাচাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ বরবার ই/এস প্রেরণ করি। সেখান থেকে মো. ইয়াছিন মিয়া, মিজমিজি পশ্চিম পাড়া বড়বাড়ি এলাকার মৃত মফিজ উদ্দিনের ছেলে।

 

 

মামলার এজহার বর্ণিত দলিল ১২৫৬ বন্দর সাবরেজিষ্ট্রি অফিস থেকে সংগ্রহ করে যাঁচাই করি। ওয়াকফ সম্পত্তি সংক্রান্তে বিতর্কিত দলিল ১২৫৬ নিয়ে পক্ষদয়ের মাঝে বিজ্ঞ আদালতে চলমান দেওয়ানী নং ২৪১/১৯৯৯, দেওয়ানী মামলা৭৫/২০০৯, ৩০৯/১৪, ২২৮/১৬,১০১/২০২০,১০২/২০২০ মামলা ফটোকপি প্রাপ্ত হই পর্যালোচনা করি। প্রকাশ্যে গোপনে তা তদন্ত করি।

 

 

মামলা এজহার ভুক্ত সম্পত্তি সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন খোর্দ্দঘোষপাড়া মৌজাস্থিত সিএস ৮৫, এসএ ৯৫ ও আর এস ১৬ নং খতিয়ান ভুক্ত সিএস ২৩০ এবং আর এস ২৯২ নং দাগের মরহুম আবদুস সাত্তার কামালের ছেলে আফছার আহম্মেদ পৈত্রিক ওয়ারিশ সূত্রে মালিক হয়ে ১৯৯৬ সনের ১৬ অক্টোবর সিদ্ধিরগঞ্জ মিতালি মার্কেট জামে মসজিদের নামে ৬৪ শতাংশ হইতে ২৯ শতাংশ জায়গা ওয়াকফ করিয়া দেন। এই সম্পত্তি কোন সভাপতি বা মোতায়াল্লি কোন অংশ দান বা হস্তান্তর করিতে পারবে না।

 

 

আমার সার্বিক তদন্ত স্বাক্ষ্য প্রমাণে তথ্য ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় আলোচ্য মামলার এজহার নামীয় আসামী শহিদ উল্লাহ,সাদেকা আক্তার,শাহনাজ পারভীন, মো. ইয়াছিন মিয়া, ফেরদৌস আহমেদ অন্যান্য আসামীদের বিরুদ্ধে পেনাল কোড আইনের ৪২০/৪১৯/৪৬৭/৪৬৮/৪৬৯/৪৭১/১০৯/৩৪ পেনাল কোড ১৮৬০ ধারার অপরাধ প্রাথমিক ভাবে সত্য বলিয়া প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ধারা মোতাবেক অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়।

 

 

এতে করে মামলার প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়ার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্যতা পাওয়া যায়। আদালতে তার প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়।

 



এছাড়া স্থানীয়দের থেকে তার বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ কান্দাপাড়া মসজিদের জায়গা সাইনবোর্ড টানিয়ে  এখানকার মসজিদ কমিটি থেকে ১ কোটি টাকা নিয়ে আত্মসাত করার অভিযোগ উঠেছে। তাই সচেতন মহল প্রশ্ন তুলেন তিনি ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি পদে থেকে কি করে মসজিদের জায়গায় আত্মসাৎ করার পায়তারা করে।

 

 

তার ভিতর কি আল্লাহর ভয় নেই। এইভাবে তিনি বিভিন্ন মানুষের জায়গা দখল, মিতালি মার্কেটের টাকা আত্মসাতের পায়তারা করে কোটিপতি বনে গেছেন বলে জানান এলাকাবাসী। তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী তোলেন স্থানীয়রা। সেই সাথে তার সম্পদ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের অভিযান পরিচালনার দাবি তোলেন।

 



এই ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন মিয়ার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এই বিভাগের আরো খবর