বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের যুবশক্তি

মাহবুব আলম প্রিয়, রূপগঞ্জ

প্রকাশিত: ২৩ মার্চ ২০২১  

মহান মুক্তির সংগ্রামে আপামর জনতার পাশাপাশি ছাত্র ও যুব সমাজের ভূমিকা ছিল অহঙ্কার করার মতো। সেদিন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন টগবগে যুবক। যুব ও ছাত্র সমাজ ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ ও ৬৪’র শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফার আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে ১১ দফার আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন, ১৯৭১’র মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। সে যুদ্ধে লুঙ্গিপড়া গ্রামের সাধারণ যুবকরাও সরাসরি যোগ দেন। স্বাধীনতা পরবর্তি  যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত পরিবেশ কাটিয়ে এ বর্তমান উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আনয়নে রয়েছে যুব সমাজের যুগান্তকারী ভূমিকা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এ দেশের যুবশক্তির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবীড় ও গভীরে।

 

১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ থেকে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে নানাভাবে শোষণ করতে থাকে। মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে ১৯৫২ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালায়। এর প্রতিবাদে  শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। তারপর ১৯৬৬ এর ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনসহ এসব ঘটনায় বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ হয়। পাকিস্তানের চাপিয়ে দেয়া বৈষম্য এবং নিপীড়ন থেকে মুক্তির উপায় শেষ উপায় হিসেবে সামনে আসে মুক্তিযুদ্ধ।
 

পৃথিবীর অন্যতম জঘন্য গণহত্যার হোতা ইয়াহিয়া খান। তার নির্দেশে অপারেশন সার্চ লাইট নামে ১৯৭১ সালের ২৫মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। হত্যাযজ্ঞ চালায় পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সে রাতে দেশের মুক্তিকামী ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনকারী শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়।

 

৪ এপ্রিল ১৯৭১ কর্নেল এম.এ.জি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিফৌজ গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পুরো দেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ কুষ্টিয়ায় মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। সে সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী করে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন। সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রধান রাজনৈতিক দল ছিলো আওয়ামীলীগ। এছাড়াও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনকালের পুরো অধ্যায়ই যুব বয়সের।

 

১৯৪৮ সাল, মাত্র ২৮ বছরে তখনকার পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতারক নেতৃত্বের বৈষম্যমূলক আচরণ দেখে এক বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুই প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন। দাবি তুলেছিলেন একটি নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশই ছিল এই যুব সমাজ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ১ মার্চ দুপুরে যুব ও ছাত্ররাও পথে নেমে আসে। তারা শ্লোগান দেন ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। ২ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসুর ভিপি আ.স.ম আবদুর রব স্বাধীন প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে অসংখ্য ছাত্র ও যুবকরা বিভিন্নভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যায়। সেখানে বিভিন্ন শিবিরে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে যুব ও ছাত্রসমাজের প্রায় ২৮ হাজার নেতাকর্মীসহ ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন। ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন লাখের অধিক।

 

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসলীলা, সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহের বিবরণ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বর্বোরোচিত হত্যাকান্ডে কাহীনি  আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়ে বিশ্বজনমত তৈরিতে এগিয়ে এসেছিলেন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের প্রায় শেষদিকে ২১ নভেম্বর ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডার লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ  ভারত যৌথ কমান্ডো।

 

১৬ ডিসেম্বর বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অর্থাৎ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে জেনারেল নিয়াজি সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং অরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করেন । এসময় বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার। এর মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।

 

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন রাজনৈতিক দলের হাল ধরেন, তখন তাঁর বয়স ৩৪। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের সময় থেকে আজ পর্যন্ত  উন্নয়ন দর্শনের যে প্রান্তে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে যুব সমাজের শক্তহাত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে আজো যুবকদের অগ্রণী ভূমিকা প্রয়োজন। এরাই দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। তাই যুব সমাজকে শক্তিতে পরিণত করতে সরকারের পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। কর্ম প্রত্যাশী অনুৎপাদনশীল যুবসমাজকে সুসংগঠিত, সুশৃংঙ্খল এবং উৎপাদন্মূখী শক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে যুব উন্নয়ন মন্ত্রনালয় সৃষ্টি করেন। যা পরবর্তীতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় হিসেবে পুনঃনামকরণ করা হয়। ১৯৮১ সালে ‘যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সৃষ্টি করা হয় মাঠ পর্যায়ে যুব ও ক্রীড়া  মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য। প্রায় ৩৬ লক্ষ যুবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রচেষ্টায়। তাদের অনেকেই দেশে ও বিদেশে সম্মানজনক সামাজিক অবস্থান করে নিতে স্বক্ষমতা হয়েছেন।
 

মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা রক্ষায় যুবসমাজ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে তেমনি দেশের মূল্যবান সম্পদ জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি যুব সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরী। যুবসমাজের মেধা, সৃজনশীলতা, সাহস ও প্রতিভাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে একটি জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিমন্ডল। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও যুব সমাজ জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার, নীতি নির্ধারক ও সিদ্বান্ত গ্রহণকারী। তাই যুবশক্তিকে যথাযথ পন্থায় কাজে লাগালে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
 

এই বিভাগের আরো খবর