মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১০ ১৪৩১

‘মৃত্যুর কাছে হেরে যেতে চাই না’

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৬ আগস্ট ২০২০  

এক সময় দাপটের সঙ্গেই চলচ্চিত্র অভিনয় করেছিলেন নারায়ণগঞ্জের ছেলে আব্দুস সাত্তার। চলচ্চিত্র জগতে তিনি সাত্তার নামেই পরিচিত। ১৯৬৮ সালে ইবনে মিজানের ‘আমির সওদাগর ও ভেলুয়া সুন্দরী’ ছবিতে শিশুশিল্পীর চরিত্রের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে আগমন।

তবে, ১৯৮৪ সালে তিনি ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে কাজ করেন কাজী হায়াৎ এর ‘পাগলী’ ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি শুধু অভিনেতা তা নয়; তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও।

সাত্তার অভিনয় করেছেন আজিজুর রহমানের ‘রঙ্গিন রূপবান’, ‘অরুন বরুণ কিরণ মালা’, ‘কাঞ্চন মালা’, ইবনে মিজানের ‘পাতাল বিজয়’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘শুভদা’, মিলন চৌধুরীর ‘রঙ্গিন সাত ভাই চম্পা’সহ প্রায় দেড় শতাধিক চলচ্চিত্রে।

জীবনের এপিঠ-ওপিঠ দেখেছেন চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা আবদুস সাত্তার। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি রোগে ভুগছিলেন। পাশে পাননি চলচ্চিত্র জগতের সহশিল্পী, শুভাকাক্সিক্ষদের। 

২০১৮ সালে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দীর্ঘ সাত মাস চিকিৎসাধিন অবস্থায় থাকাকালিন সময়ে জানিয়েছিলেন, জীবনের এই পর্যায়ে আসার পর দুই-একজন ছাড়া চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কেউই তার খোঁজখবর রাখেনি। এ নিয়ে ভীষণ দুঃখ ছিল তার। ঠিকমতো কথা বলতে না পারলেও ভাঙা স্বরে বাঁচার আকুতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি বাঁচতে চাই, মৃত্যুর কাছে হেরে যেতে চাই না।’

অভিনেতা আবদুস সাত্তার সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছিলেন চিত্রনায়িকা রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, নায়করাজ রাজ্জাক ও চিত্রনায়িকা শাবানাকেও। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় নায়িকাকে তিনি সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন। তার জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘রঙিন রূপবান’, ‘অরুণ বরুণ কিরণ মালা’, ‘শুভদা’, ‘সাত ভাই চম্পা’ উল্লেখযোগ্য।

আবদুস সাত্তারের স্ত্রী আয়েশা আক্তার কাকলী জানিয়েছিলেন, ‘এফডিসিতে শিল্পী সমিতিতে আমার স্বামীর অসুস্থতার বিষয়টি জানালেও তারা এরপর আর কোনো খবর নেননি।’

সাত্তার জানিয়েছিলেন, ‘এ দেশে শিল্পীদের সম্মান সব এফডিসির ভেতরেই। সেখান থেকে বের হয়ে গেলে কেউ আর সম্মান করে না। আজ আমার এ অবস্থা। অথচ কেউ একবারের জন্য হলেও দেখতে আসেনি, কিংবা ইন্ডাস্ট্রির যারা সিনিয়র অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন, তারাও কোনো ধরনের খবর নেননি। আমার যৌবনের পুরোটা সময় আমি এখানে ব্যয় করেছি। কী স্বার্থপর এ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি! আমার ঘৃণা হয় ভেবে!’ এরপর কাঁদতে শুরু করেন তিনি। বলেছিলেন, ‘জীবন তো বয়ে চলা নদীর মতো। অথচ এই নদীতে কোনো মাঝির দেখা পেলাম না, যে আমার জীবনটাকে বয়ে নিয়ে সুন্দর আরেকটা জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে।

বিধাতার কত খেলা দেখলাম এক জীবনে! আরও তো দেখতে হবে। আমি তো বাঁচতে চাই, মৃত্যু যেন আমাকে আলিঙ্গন করতে না পারে। মৃত্যুর কাছে হেরে যেতে চাই না।’

সাত্তারের স্ত্রী কাকলী জানিয়েছিলেন, ‘আমার স্বামী প্রতিদিনই জানতে চাইতেন, সিনেমার কেউ তাকে দেখতে আসবে কিংবা কথা হয়েছে কি না। আমি তাকে প্রায়শই মিথ্যা বলতাম, আজ বলি ওর কথা, কাল বলি আরেকজনের কথা। আইসিইউর একটা রোগীকে মিথ্যা বলা ছাড়া আমার কিইবা করার আছে! কিন্তু তারা কেউ আসেনি (২০১৮)।’

প্রথম স্ত্রীর পরিবারের কেউ এই অভিনেতার খোঁজ নিচ্ছেন না বলে দাবি করেছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী। কাকলী যখন এ কথাগুলো বলছিলেন, তখন বিছানায় শুয়ে ডুকরে কাঁদছিলেন সাত্তার। ‘এ জীবনের মানে কী?’ বলে প্রতিবেদকের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন এ অভিনেতা। তারপর বলেছিলেন, ‘আমি এভাবে কষ্ট পেয়ে মরতে চাই না। হেরেও যেতে চাই না।’

চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর চিত্রনায়ককে এককালীন ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এরপর থেকে প্রতি মাসে ১০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন। এ কথা কাকলী জানিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। 

কাকলীর ভাষ্য, আবদুস সাত্তারের প্রথম পরিবারের লোকজন তার সঙ্গে বেশ দুর্ব্যবহার করেছেন। তারা চায় নারায়ণগঞ্জে নিয়ে গিয়ে কোনো একটা হাসপাতালে সাত্তারকে চিকিৎসা করানোর জন্য। এতে আপত্তি জানানোতে একটা সময় গিয়ে কাকলীকে তারা মারতেও চেয়েছিলেন বলে দাবি করেন তিনি। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিয়ে তিনি সে পরিবারের নামে জিডি করেছেন।

অভিনেতা সাত্তার চান আগের মতো সুস্থ হয়ে সুন্দর একটা জীবনযাপন করতে। সুন্দর এ পৃথিবীতে আরও অনেক দিন বেঁচে থাকতে। তার ভাষ্য, ‘কেউই কী নেই আমাকে বাঁচতে, আমার পাশে দাঁড়াতে, আমাকে বাঁচাতে। সিনেমার গল্পে তখন প্রেম হারিয়ে গিয়েছিল, আমার ছবি দিয়ে হলমুখী হয়েছিল দর্শক। বিনিময়ে ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা আমাকে ভালোবাসা দিলো না।’ মৃত্যুর আগে এভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন বহু জনপ্রিয় সিনেমার নায়ক সাত্তার।
 

এই বিভাগের আরো খবর