শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

রূপগঞ্জে ২০ একর ৯৫ শতক বনের জমি বেদখল!

মাহবুব আলম প্রিয়

প্রকাশিত: ১৩ মার্চ ২০২১  

পূর্বাচলের সীমানার বাইরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের কুলিয়াদি মৌজার বনবিভাগের জমি পুরোটাই বেদখল হয়ে পড়েছে।  এসব জমি চলে গেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কব্জায়। কাগজে কলমে বনবিভাগের জমি হলেও এখানে দেখা যায় শতাধিক বসত ঘর। আর দিনদুপুরে মাটি ও গাছ কাটার হিড়িক। আবার বনের গাছ সহজে আসবাব তৈরী কাজের প্রস্তুত করতে রয়েছে ৩টি করাত কল। যার কোনটির নেই সরকারী অনুমোদন। অভিযোগ রয়েছে উপজেলার ৫২ টি করাত কলের মধ্যে ৫১টিরই বৈধ সনদ নেই।  এ যেন ঘটা করেই চলছে দখল ও লুটপাটের মহোৎসব। 


সূত্র জানায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকেই ভাওয়াল রাজার ভোগদখলীয় স্ট্যাটগুলো ক্রমেই বেদখল হয়ে পড়ে। চোরাকারবারী ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের অপতৎপরতায় গজারী বনগুলো ধ্বংস করা হয়।  এর মাঝে রূপগঞ্জের গোবিন্দ্রপুরের গুচ্চগ্রাম, গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী  ইউনিয়নের বরকাউ ও পারাবর্তা মৌজার বন পূর্বাচলের সীমানা হলেও রক্ষা পায়নি  দখলদারদের হাত থেকে। 


স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা ফজজুল করীম মাস্টারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় লাখ লাখ গজারী গাছে সমৃদ্ধ ছিল  কুলিয়াদি মৌজার এ বন।  এ বনের অধীনে  ছিলো  অর্ধশত প্রাকৃতিক টেক ও টিলা।  খুব বেশি দিনের কথা নয় । মাত্র ৩০  বছর পূর্বেই এ বনে দেখা মিলতো বানর, হনুমান, বাঘডাস, খরগোশসহ নানা প্রজাতির পাখি। এ বনেই স্বাধীনতা পূর্বপর্তি বাঘ , সিংহ ও হরিনের অবস্থান ছিলো। এছাড়াও ভাওয়াল রাজার স্ট্যাটের সঙ্গে এ বনের সংযোগ থাকায় রাজার তৎকালীন হরিণের বন হিসেবেই ছিলো এর খ্যাতি। 


স্থানীয়দের অভিযোগ , সময়ের ব্যবধানে, কর্তৃপক্ষের নজরদারীর অভাবে  রূপগঞ্জের দাউদপুর ইউনিয়নের কুলিয়াদি মৌজার বনবিভাগের ২০ একর ৯৫ শতক জমি অবৈধভাবে দখলে নেয় নানাজনে। স্থানীয়  প্রভাবশালীরা বসতি নির্মাণ করে বনের জমিকে নিজের বলে দাবী করতে থাকে।  দখলদারদের কেউ কেউ  বনবিভাগের বিরুদ্ধে নারায়নগঞ্জ কোর্টে মামলাও দায়ের করেন।


  অভিযোগ রয়েছে, বনবিভাগের জায়গা দখল করে ভূয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে বিক্রি করে দেয়ার। আবার দখলদাররা আইনি ঝামেলা এড়াতে কৌশলে জমি হস্তান্তর করে খোলা স্ট্যাম্পে। প্রভাব খাটিয়ে দখল করা জমি  অন্যের কাছ থেকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়  বাড়িঘর করার সুযোগ দেয়।  এর আগে বনের মাটি চুরি আর গাছ কেটে সাবার করে ফেলে তারা। চোরাই গাছ বিক্রি করেন বনের অধীনে থাকা করাত কল মালিক কিংবা কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছে।  করাত কল মালিকরা বনের গাছ হলে অর্ধেক মুল্যে ক্রয় করে তা বাহিরে বিক্রি করে দেয়। চোরাই কাঠ ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে  কুলিয়াদির বন বিভাগের জমিতে রয়েছে  ৩ টি করাতকল। এসব করাতকল মালিকদের একজন মোক্তার হোসেন। তিনি বলেন, বন বিভাগ বা প্রশাসনের কেউ আমাকে কোনদিন বাঁধা দেয়নি। তাছাড়া কাঠ কাটার প্রয়োজনে চিরাই করি। গাছের মালিকরা গাছ চুরি করে আনলো বা তাদের বৈধ গাছ কি না এসব যাচাই করা আমার কাজ নয়। 


সূত্র জানায়, বিগত সময়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দখলদারদের উচ্ছেদের  চেষ্টা করলেও  কোর্টে মামলা থাকায় অভিযানে সফল হননি তারা। এছাড়াও  রূপগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন বনবিভাগ দখল নিয়ে তদন্ত  করে একটি  একাধিকবার  প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক বরাবর দাখিল করেছিলেন।  তবে দখলদাররা দাবী করেন,  সিএস পর্চামূলে তারাই মালিক। এসএ ও আরএসে মালিক বনবিভাগ। যখন সরকার রায় পাবে তখন তারা বনবিভাগের জমি ছেড়ে দিবে।
 এদিকে আরএস রেকর্ড সূত্র ধরে দাউদপুর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা(ভারপ্রাপ্ত) মজিবুর রহমান জানান,  রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের কুলিয়াদি মৌজার এসএ ও আরএস পর্চামূলে ২নং খতিয়ানের ২৫টি  দাগে ২০ একর ৯৫ শতক  জমি বনবিভাগের। এ রেকর্ডের  মালিক হিসেবে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট। বিধি অনুসারে এসব জমির বৈধ মালিক বনবিভাগ। 


সূত্র জানায়,  রহস্যজনকভাবে কিছু দাগের  দখলীয় কলামে  ভিটি ও বাড়ির কথা উল্লেখ্য করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন জড়িপ কর্মকর্তাদের অসাদু কর্মকান্ডে অবৈধ দখলদারদের বৈধতার দেয়ার চেষ্টায় রেকর্ডে দখলীয় কলামে এমনটা করেছেন। 


সরজমিনে ঘুরে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দাউদপুর ইউনিয়নের মিয়া আর খাঁ বংশীয় লোকদের দখলে  রয়েছে  কুলিয়াদি এলাকার এ বনের বেশিরভাগ জমি। মিয়া বংশীয় হলেন শিমুলিয়া এলাকার মরহুম মহসিন মিয়ার বংধর আর কুলিয়াদির বাসিন্দা আরমান খাঁন এর বংশীয়রা।  আবার যে দল যখন ক্ষমতায় আসে এমন প্রভাবশালীরাও ধারাবাহিকভাবে এ বনের জমি দখলে নেয়। এতে তাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে করা হয় সিন্ডিকেট।  এ সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছে, কুলিয়াদির বাসিন্দা  ফজলু হক সিকদার, মহর আলী, সেরাজুল মিয়া, গেসু মিয়া, মান্নান মিয়া, ফিরোজ খান, সিরাজ  ভূইয়া, আব্দুর রেজাক, আজগর হোসেন, সামসুল হক, আজহারুল ইসলাম, আয়নাল হক, মজিবুর রহমান, ইমরান মিয়া, অলিউল্লাহ মিয়া, সেলিনা বেগম, মালেকা বেগম, মোশারফ হোসেন, আতাবর মিয়া, জুয়েল মিয়া, ইমরান মিয়াসহ আরো শতাধিক লোক। এদের মাঝে  কেউ কেউ বনের জমি দখল করে ভূয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে জমি বিক্রি করে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ বাড়ীঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছে। 

 

এমন এক দখলদার সেলিম মিয়া  বলেন,  এক সময় এসব জমি প্রজাই জোতের অধীনে ছিলো। এখন  এসএ ও আরএসে বনবিভাগের লেখা হয়েছে।  তবে দখলে পূর্বের লোকজনই রয়েছে। বনবিভাগের কোন দখল নাই।  তবে সাবেক রূপগঞ্জ উপজেলা বনকর্মকতা রিয়াজউদ্দিন  বলেন, সীমানা পিলার  দিয়ে বনের জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। 

 


রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ নুসরাত জাহান বলেন, বনের জমি বিষয়ে দখলদারদের করা আদালতে মামলা চলমান। তবে  বনের জমি উদ্ধার করে ওখানে ইকো পার্ক গড়ার  বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন আইনি তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।  বনকর্মকর্তার সঙ্গে বসে বিষয়টি জেনে আইনি ব্যবস্থা নেব। তিনি আরো বলেন,  করাতকল স্থাপন আইন বিধি অনুযায়ী কোন করাতকল প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম চালালে ২ মাস থেকে ৩ বছরের সাজা ও এর অতিরিক্ত ন্যূনতম ২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেয়ার বিধান রয়েছে। 


রূপগঞ্জ উপজেলা বন কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার বলেন , রূপগঞ্জের মাঝে কেবল ২০ একর ৯৫ শতক কাগজে কলমে বনের রয়েছে। লোকবল না থাকায় এসব জমি পুরো দখলে আনা সম্ভব হয়নি। যদিও বনের সীমানা পিলার দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন মহলকে জানিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এ সময় তিনি আরো বলেন, বনবিভাগের কাঠ কাটা ও বৃক্ষনিধনে কেউ জড়িত হয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মামলা করা হবে বলে জানান তিনি।
 

এই বিভাগের আরো খবর