বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

শিউলি-লুনার চাপে কোনঠাসা খোরশেদ

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ৬ মে ২০২১  

কারো পৌষ মাস আবার কারো সর্বনাশ। ঘরে-বাইরে চাপে আছেন ১৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর করোনা বীর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। একে তো ইটিশ-পিটিশ করে দ্বিতীয় স্ত্রী সায়েদা শিউলিকে বিয়ে করার সময় প্রথম স্ত্রী  আফরুজা খন্দকার লুনার কাছ থেকে অনুমতি নেননি। দ্বিতীয়ত, দুই ড্রাইভারের কল্যাণে লুনা জানতে পারার পর শিউলিকে নিয়ে নয়-ছয় করে রাজনীতিকরণের চেষ্টা করেছিলেন খোরশেদ।

 

তবে পানি সেখানেই থাকেনি, গড়িয়েছে। শুধু গড়ায়ইনি, বহুদূর গড়িয়েছে। এক নারী বিরক্ত করছে আর হুমকি দিচ্ছে এমন কথা বলে ফেসবুক লাইভ ও থানায় জিডি করেছিলেন খোরশেদ। ভেবেছিলেন মানুষের সিমপ্যাথি নিয়ে সায়েদা শিউলিকে নাজেহাল করবেন। অনেকে এঘটনাটির মধ্যে ভোটের গন্ধ পেলেও আসলে ব্যাপারটি ছিল একান্তই পারিবারিক। আর পারিবারিক ব্যাপারটিকে রাজনীতির রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন কাউন্সিলর খোরশেদ নিজেই। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, থলের বিড়াল বেড়িয়ে এসে নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে যাচ্ছেন খোরশেদ।

 

তিনি নিজেই একটি বই লিখেছেন ‘ছড়ায় ছড়ায় বাংলাদেশ।’ সেখানে ‘মানুষ ও মুখোশ’ নামে একটি কবিতাতে যেন নিজেকেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন খোরশেদ। তিনি লিখেছেন, তুমি কি চিনেছো মানুষ, বন্ধু! নাকি মানুষ চিনেছে তোমায়? মানুষ চেনার আক্ষেপ বন্ধু, মুখোশ মানুষকে কাঁদায়। যাকেই ভাবছি মানুষ আমি, সেও মুখোশ পরা, মুখোশের ভিড়ে মানুষ খুঁজি, আসল মানুষ কারা? আমিও কি তবে মুখোশ মানব, আমিও কি নই মানুষ! মুখোশ পরা মানুষের চেয়ে, অনেক ভালো মানুষ! মুখোশের চেয়ে অমানুষ ভালো, ওদের চেনা যায় তবু, মুখোশ পরা কপট মানুষ, চেনা যায়না কভু। এসো সবাই মুখোশ মুখে, মানুষ হয়ে যাই। সাবর উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ 


সূত্র জানিয়েছে, ২৪ মার্চ ফেসবুক লাইভে কাউন্সিলর খোরশেদ দাবি করেছিলেন, এক নারীর সাথে তিনি কথা বলেন। এখন ওই নারী তাকে বø্যাকমেইলিং করছে, তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করছে, হুমকি-ধমকি দিচ্ছে এমনকি কাজী নিয়ে এসে তার বাড়িতে বিয়ে করতে চেয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে ওই নারীর বৈবাহিক বিষয় নিয়েও নানা কুৎসা রটনা ও কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করেছেন খোরশেদের একান্ত আস্থাভাজনরা। কিন্তু খোরশেদ এবং তার প্রথম স্ত্রী লুনা ফেসবুকে লাইভে আসার আগে ২ মার্চ ফতুল্লা মডেল থানায় দিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। সেই জিডির তদন্ত এখন আদালতে। সেখানে খোরশেদ বলেছেন, গতবছর জুলাইয়ে শায়েদা শিউলির সাথে তিনি ফেসবুকে যুক্ত হন।

 

খোরশেদ দাবি করেছেন ‘তাকে ওই নারী প্রলুদ্ধ করে বলেছেন, তাকে (খোরশেদ) বিয়ে করে সংসার করতে হবেনা। শুধু টেলিফোনে কথা চালিয়ে গেলেই হবে। খোরশেদ জিডিতে দাবি করেন, ওই নারীর দুটি বিয়ে হয়েছে, তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া সন্তান রয়েছে। এখানেই আসলে খোরশেদ শুভঙ্করের ফাঁকির আশ্রয় নিয়েছেন। বলেছেন, ফেসবুকে তিনি ওই নারীর সাথে পরিচিত হয়েছে। অথচ ১৯৯০ সালের দিকেই ওই নারীর ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন খোরশেদ। যার হাজারো প্রমাণ খোরশেদের বন্ধু-বান্ধব এবং ইসদাইর এলাকার বাসিন্দা। এছাড়া খোরশেদ সমর্থকরা  যেখানে নারীর চরিত্র হনন করছেন সেখানে খোরশেদই বলছেন সায়েদা শিউলির দুটি বিবাহ হয়েছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৩ সালে সায়েদা শিউলির প্রথম বিবাহ হয় এবং ২০১৫ সালে সেটির বিচ্ছেদ ঘটে। তার তিনটি সন্তান রয়েছে। এসব সবই জানতেন খোরশেদ। কিন্তু কেন তিনি পুরনো প্রেম বিয়েতে রূপ দিলেন সেটিতেও রয়েছে চমকপ্রদ তথ্য।  সায়েদা শিউলির দ্বিতীয় বিবাহ নিয়ে যে অপপ্রচার খোরশেদসহ তার সমর্থকরা করছেন সেটিও ভালো করে জানেন খোরশেদ। এছাড়া দ্বিতীয় বিয়ের যাকে স্বামী হিসেবে দেখানো হচ্ছে সে কী কারণে খোরশেদের টোপ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে খোরশেদের করা জিডি তদন্তেই সেসব বেরিয়ে আসবে। 


সূত্র জানিয়েছে, করোনা বীর খোরশেদের ভিন্ন রূপটি মানুষ জানতো না। খোরশেদ ফেসবুক লাইভে এসে আবেগঘন কণ্ঠে যখন এক নারীর প্রতারণা করার ঘটনা বর্ণনা করছিলেন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সহানুভূতি পান তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে খোরশেদের বিবর্ণ রূপটি মানুষের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে। সূত্র জানায়, ফেসবুক লাইভে খোরশেদ বলছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই নারীর সাথে কথা বলতেন। কিন্তু জিডিতে খোরশেদ ও তার প্রথম স্ত্রী লুনা নিজেরাই ফিরিস্তি দিয়েছেন ওই নারীর সাথে তাদের বেশ কয়েকবার সশরীরের যোগাযোগের ব্যাপারে।

 

খোরশেদ নিজেই জিডিতে উল্লেখ করেছেন, সায়েদা শিউলী যিনি খোরশেদের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করছেন তার (শিউলির) গাড়ি খোরশেদের বাড়িতে অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর পর্যন্ত রাখেন। এরপরেই তিনি ব্ল্যাক মেইলিং বাড়িয়ে দিয়ে হত্যার হুমকি দেন। প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক, গাড়ি রাখার তিন মাসের মধ্যে কি এমন ঘটলো উপকারী খোরশদকে হত্যার হুমকি দিতে হলো। খোরশেদ দাবি করেন, ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি খোরশেদকে বিয়ে করার জন্য কাজী নিয়ে ওই নারী তার বাড়িতে যান। একথা ফেসবুকে দাবি করলেও  পরের কথাগুলো তিনি লুকিয়ে যান। সেটি তিনি জিডিতে বলেছেন, ১৮ ফেব্রæয়ারি ও ২১ ফেব্রæয়ারিও ওই নারীর সাথে তার দেখা হওয়ার বিষয়টি গোপন করে যান।

 

অথচ জিডিতে খোরশেদ বলেন, ২১ ফেব্রæয়ারি ওই নারী তার বাড়িতে গিয়েছিলেন একা।  সেখানে তার বুয়া তাকে বের করে দেন। এর অর্থ দাঁড়ায় সায়েদা শিউলিকে খোরশেদের পুরো পরিবার অত্যন্ত ভালো করে চেনেন। সেখানে খোরশেদ দাবি করেন, খোরশেদের এলাকার বিভিন্ন মানুষ ও খোরশেদের আত্মীয়দের ফোন করেছেন ওই নারী। তাহলে প্রশ্ন খোরশেদের ব্যক্তিগত ফোনে থাকা পারিবারিক নাম্বার ওই নারী পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছাল। এছাড়া খোরশেদ জিডিতে দাবি করেছন, ২৭ ফেব্রæয়ারি সন্ধ্যায় ও রাতে দুই দফায় ওই নারী খোরশেদের বাড়িতে আবারও ঢুকার চেষ্টা করে। শুধু এখানে সমাপ্ত নয়, খোরশেদ দাবি করেছেন জিডিতে, ১ মার্চ রাত নয়টায় খোরশেদের বাড়িতে আবারও যান ওই নারী। সেদিনই রাত ৩টায় একটা কালো হাইস ও একটা প্রাডো গাড়ি দিয়ে বাড়ির গেটে ধাক্কাধাক্কি করেন ওই নারী।

 

খোরশেদ জিডিতে উল্লেখ করেছেন, ওই নারীর বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছেলেকে তার মায়ের ব্যাপারে বলেছৈন ডিসেম্বরে। তার মানে খোরশেদ ওই নারীর পুরো পরিবার সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল। খোরশেদ জিডিতে উল্লেখ করেন, নভেম্বরে ওই নারীর ভগ্নিপতিকেও জানিয়েছেন খোরশেদ। খোরশেদ দাবি করেন তার পিওন ও  ড্রাইভারকেও অর্থের লোভ দেখিয়েছেন ওই নারী। তাদেরও হুমকি ধামকি দিচ্ছেন। এর অর্থ জিডিতেই খোরশেদ পরিষ্কার করেছেন ওই নারী ও তার সাথে সম্পর্কটা বেশ পুরোনো এবং একজন আরেকজনের পরিবারের সম্পর্কে খুবভালোভাবে জানেন, এবং আসা-যাওয়া রয়েছে।  


এদিকে সূত্র জানিয়েছে, খোরশেদ দম্পত্তির জিডি নিয়েও চলছে তেলেসমতি। থানায় দায়েরকৃত ওই জিডির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শফিকুল ইসলামকে। তিনি ইতিমধ্যেই ফতুল্লা থেকে সোনারগাঁ থানায় বদলি হয়েছেন। ফলে জিডির তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল দৈনিক যুগের চিন্তাকে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ফতুল্লায় নেই। বদলি হওয়ায় ওই জিডি হস্তান্তর করেছি। জিডির তদন্ত চলছে। তদন্তের জন্য কোর্টে পাঠানো হয়েছে। এখন কোর্টের আদেশের অপেক্ষায় আছে। তদন্তের পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর আমি জিডির কপি থানায় হস্তান্তর করে যাওয়ায় আমার পরিবর্তে যিনি তদন্ত ওসি হিসেবে দায়িত্বে এসেছেন, সম্ভবত তিনিই এটার তদন্তের দায়িত্ব পাবেন।’


তবে, ফতুল্লা মডেল থানার বর্তমান ইন্সপেক্টর (তদন্ত) তারিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম আমাকে ওই জিডির কাগজ হস্তান্তর করেনি। তাই ওই জিডির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’  


এই বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুজ্জামান দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘জিডির কপিটি সে (তদন্ত শফিকুল ইসলাম) আমার কাছে বুঝিয়ে দেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী এটা আমার কাছে বুঝিয়ে দেয়ার কথা। আর তিনি যদি জিডির কপি কোর্টেই পাঠান, তাহলে থানায় বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে? আবার থানায় বুঝিয়ে দিলে কোর্টে পাঠালো কী? এটা একটা সাধারণ ডাইরি, এখানে লুকানোরতো কিছু নেই। তাই বিষয়টা তারই ক্লিয়ার করা উচিৎ যে, তিনি এটা কি করেছেন।’  


খোরশেদ দম্পতির এমন দাবির প্রেক্ষিতে সাইদা আক্তার শিউলী জানিয়েছেন, খোরশেদ ও তার প্রথম স্ত্রী যা অভিযোগ এনেছে জিডির তদন্ত কর্মকর্তা সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে গেলে যেমন প্রকৃত সত্য বেড়িয়ে আসবে, তেমনই তিনিও সকল তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে প্রস্তুত রয়েছেন। ১২০০ পৃষ্ঠার তথ্যপ্রমাণও রয়েছে তার কাছে।  


প্রসঙ্গত, সায়েদা শিউলি নামের ওই নারীর ভাষ্য অনুযায়ী, গত ২ আগস্ট কাঁচপুরে শিউলির মালিকানাধীন এসএস সিএনজি ফিলিং স্টেশনে সাথে কাজী নিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে করেন খোরশেদ।মজার বিষয় হচ্ছে, গতবছর করোনার সময় ওই নারীর সাথে পরিচয় হয়েছে ফেসবুক লাইভে খোরশেদ এমন দাবি করলেও আসলে সায়েদা শিউলির গালর্স স্কুলে ১৯৯০ সালের দিকে পড়াকালীন সময়ে তাঁর ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্বের সুযোগে প্রেম হয়  খোরশেদের। পরে ওই নারীর পরিবার বিষয়টি জানতে পারলে তাকে বিয়ে দিয়ে  দেয়। এনিয়ে ওই নারীর ভাইয়ের সাথেও বন্ধুত্বে বেঈমানি করেন খোরশেদ।

 

দীর্ঘ তিনদশক পর ওই নারীকে খুঁজে বের করেন  খোরশেদ। নানাবাহানায় ফুঁসলিয়ে ওই নারীকে পুরনো প্রেমের ফাঁদে কাছে টানেন। পিছ অব হার্ট অর্থাৎ কলিজার টুকরা বলে কাছে টানেন, এছাড়া দিনে হাজারো বার কখনো পাগলী, কখনো নিশু বলে জালে ফেলেন। সম্পর্কের ব্যাপ্তি এতোখানি ছড়ান সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ওই নারীর বাড়ির চতুর্পাশের মানুষ তাকে খোরশেদের ছোট বউ হিসেবেই জানেন। বিপত্তি বাধে যখন খোরশেদ ও ওই নারীর অস্থায়ী ড্রাইভার খোরশেদের প্রথম স্ত্রী লুনার কাছে সব বলে দেন। রাজনীতিবিদ খোরশেদ তখন রাজনীতির চাল দেয়া শুরু করেন সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ওই নারীকে নিয়ে। খোরশেদের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করা নারী আই-মা গ্রুপের এমডি সায়েদা শিউলি সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি এফবিসিসিআই ও বিজিএমইএ’র সদস্য। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ সিএনজি অনার্স এসোসিয়েশন নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের সভাপতি।
 

এই বিভাগের আরো খবর