শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

শিক্ষকরা পরিণত হচ্ছে লাঞ্ছনার লক্ষ্যবস্তুতে

নীরব প্রকাশ

প্রকাশিত: ৬ জুলাই ২০২২  

 

# মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দূষছেন বিশেষজ্ঞরা
# সামাজিকভাবেও গুরুত্ব আরোপের দাবি

 

একজন শিক্ষকের গুরুত্ব কতখানি তা বুঝাতে গিয়ে এক গুরুভক্ত কবি বলেছেন ‘বাপ মাত্র জন্ম দিল, গুরু দিল জ্ঞান/অন্ধকের তরে যেন দিল চক্ষুদান।’ অর্থাৎ একজন সন্তানের জন্মদাতা পিতা হলেও তার ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর হিসেবে জ্ঞান দান করার মাধ্যমে একজন শিক্ষক তার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে থাকেন। তাই শিক্ষক তার শিষ্যকে জ্ঞান চক্ষু দান করার মাধ্যমে দ্বিতীয় জন্ম প্রদান করেন।

 

অন্যদিকে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ তার ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতায় শিক্ষকের সম্মান দেখাতে গিয়ে লিখেছেন ‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির/সত্যই তুমি মহান উদার, বাদশাহ্ আলমগীর।’ অর্থাৎ যে শিক্ষা ব্যবস্থা একটি দেশের ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করে, যার কারিগর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষকরা। আমাদের দেশে বর্তমানে সেই শিক্ষকদেরকেই হেয় প্রতিপন্ন করার যেন রেস লেগেছে। শিক্ষকদের গণসম্মুখে অপমান করা, তাদের গায়ে হাত তোলা এমনকি শিক্ষার্থীরা তাদের গুরু বা শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অবস্থা দৃষ্টে এমন মনে হচ্ছে যে, শিক্ষকের মত অসহায় প্রাণী পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই


 
ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নড়াইল সদরের এক কলেজছাত্রের পোস্টকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পুলিশ প্রশাসন ও জনগণের উপস্থিতিতে গত ১৮ জুন মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে ঘুরানো হয়। অন্যদিকে সাভারের আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত ২৫ জুন নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রের স্ট্যাম্পের আঘাতে মারাত্মক জখম হন রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এবং শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উৎপল কুমার সরকার (৩৫)।

 

পরে ২৭ জুন সকাল সোয়া ৫টার দিকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারাযান ওই শিক্ষক। অভিযুক্ত সেই শিক্ষার্থী একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। গত ২২ মার্চ সকালে বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালীন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক ১৯ দিন কারাগারে থেকে গত ১০ এপ্রিল মুক্তি পান তিনি।


 
গত ২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে প্রকাশ্যে শিক্ষার্থী, জনগণ, প্রশাসন ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে কান ধরে উঠবস করানো হয়। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লে দেশ ও দেশের বাহিরে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। সেই ঘটনার পর ঘুষ নেওয়ার অপরাধে সেই শ্যামল কান্তি ভক্তকে কারাগারে পাঠানো হয়।


 
এর আগে গত ২০১৬ সালের মার্চ মাসে সুনামগঞ্জ জেলায় ধর্মপাশা উপজেলার নোয়াগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই জন শিক্ষককে মারধর ও লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটে। বিদ্যালেয়র সভাপতি সর্বানন্দ তালুকদার ঐ বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষিকা দিপালী রানী দাস ও মনি রানী দাসকে বেধরক মারধর করে বলে খবরে প্রকাশিত হয়। এমন কি বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে মহিলাদের গায়ে মারধরের চিহ্নের ছবিও প্রকাশ করা হয়।


 
২০১৯ সালের মে মাসে পাবনার একটি কলেজে নকল করতে না দেওয়ার অপরাধে ছাত্র কর্তৃক লাঞ্ছনার শিকার হন শিক্ষক। সেই ঘটনায় ভাইরাল হওয়া কলেজের সিসিটিভি’র একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় কলেজ গেট থেকে মোটরসাইকেল যোগে বের হওয়ার সময় কয়েকজন যুবক এসে অতর্কিত হামলা চালায় শিক্ষক মাসুদুর রাহমানের উপর। তাকে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি ও থাপ্পড় মারা হয়। ফেলে দেয়া হয় মাথার পাগড়িও। একপর্যায়ে তিনি বেরিয়ে যেতে চাইলে পেছন থেকে এসে তাকে লাথি মারে এক যুবক। সেই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর একজন শিক্ষককে নির্যাতনের প্রতিবাদের নিন্দা জানিয়েছেন অনেকেই।


 
এভাবে শুধু উল্লেখিত ঘটনাই নয়, এর বাইরেও পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় শিক্ষকদের লাঞ্ছনার ঘটনার একাধিক সংবাদ পাওয়া যায়। তাই বিবেকবান মানুষের প্রশ্ন ,আর কত শিক্ষক নির্যাতন ঘটনার পর সতর্ক হবে আমাদের সমাজ। আর এখনি সতর্ক হতে না পারলে মানুষ গড়ার কারিগর খ্যাত এই শিক্ষকতার পেশায় ভবিষ্যতে কোন বিবেকবান মানুষ আসতে ভয় পাবেন।এমই/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর