মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৩ ১৪৩১

শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মাষ্টমী

রণজিৎ মোদক 

প্রকাশিত: ১০ আগস্ট ২০২০  

পৃথিবীতে যখনই ধর্মের গ্লানী হয় এবং পাপ বৃদ্ধি পায়, তখনই আমি শরীর ধারণ করে কল্যাণের জন্য অবতীর্ণ হই। ভাগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, তার জন্ম, কর্ম সবই দিব্য। কেউ যখন তা তত্ত্বগতভাবে জানতে পারে তখন তিনি ভাগবতদ্ধামে প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করেন। 

লীলা পুরুষোত্তম পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের আবির্ভাব শুভ জন্মাষ্টমী উৎসব আজ। সনাতন ধর্মের স্রষ্টা এবং রক্ষক স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান। তার মহান গীতাই শান্তির পথ প্রদর্শক। বিশ্বের সবাই আজ শান্তির প্রত্যাশী।

দ্বাপর যুগ। পাঁচ হাজার বছর আগে রাজা কংসের অত্যাচারে প্রজাকুল অতিষ্ঠ ছিলো। পৃথিবী পাপের ভারে তখন ক্রন্দসী হয়ে উঠেছিলো। সাধু সন্যাসীরা দিনরাত প্রার্থনা করছেন, হে মধুসুদন, হে মাধব তুমি মধু কৈঠবকে বধ করেছিলে। রাবন, কুম্ভকর্ণ হিরন্যকশিপুকে হত্যা করেছো। 

দুষ্টাচার কংসের হাত থেকে এ ধরনীকে রক্ষা কর। দুষ্টের দমন করে ধার্মিকদের পরিত্রান কর প্রভু। ভক্তের প্রার্থনায় ভগবান ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন। অবলীলাক্রমে সুর সেনের পুত্র বসুদেব, দেবকের কন্যা দেবকীকে বিয়ে করে তার নব বিবাহিত পত্নীকে নিয়ে রথে চড়ে প্রাসাদে ফিরছেন। 

উগ্র সেনের পুত্র রাজা কংস তার ভগ্নী দেবকীকে প্রসন্ন করার মানসে বসু দেবের রথের সারথী হয়ে সেই রথে যাচ্ছিল। এমন সময় আকাশ বাণী হলো কংস, তুমি অতি নির্বোধ। মুর্খতার বশে তুমি তোমার ভগ্নী এবং ভগ্নীপতির রথ চালিয়ে যাচ্ছো। তুমি জান না যে, এই ভগ্নির অষ্টম গর্ভের সন্তান তোমার মৃত্যুর কারণ হবে।

আকাশবাণী শোনা মাত্রই কংস তার অসি দিয়ে দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হন। এসময় বসুদেব তার নির্দয়, নির্লজ্জ শ্যালক কংসকে শান্ত করার জন্য মধুর কন্ঠে বললেন, হে প্রিয় কংস। আপনি যর্শস্বী রাজা, শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এবং মহাবীর। আপনি কেন এভাবে মৃত্যুভয়ে ভীত হচ্ছেন? মৃত্যুকে আপনার এত ভয় কেন? 

জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু লেখা হয়েছে। একটা শিশুর জন্ম নিয়ে কেন এত বিচলিত হলেন? মানুষ স্বাভাবিকভাবেই চঞ্চল। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এ পঞ্চম ইন্দ্রিয়ের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে মানুষ। বসুদেব নানা রকম সুন্দর উপদেশ এবং দার্শনিক বিচার দ্বারা কংসকে শান্ত করলেন। মুখ্য ও ক্রোধাতুরকে আদর দিয়ে বসে আনতে হয়। সেই পথই বেছে নিলেন বসুদেব। 

বোনকে পিতার ন্যায় রক্ষা করাই ভাইয়ের কর্তব্য। প্রিয় কংস তুমি শান্তহও। তোমার ভগ্নির পক্ষ থেকে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, দেবকীর গর্ভের সন্তানদেরকে তোমার হাতে জন্মের পর তুলে দেবো। এ কথায় কংস শান্ত হলো।

কংস শান্ত হলো সত্য। কিন্তু তার অন্তরে মৃত্যু ভয় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তাই দেবকী এবং তার স্বামী বসুদেবকে অন্ধকার কারাগারে বন্দি করলেন তিনি। কর্মের বিপাকে বন্দিশালায় একে একে আটটি পুত্র সন্তান এবং একটি কন্যা হল। কংস আত্মরক্ষার জন্য একে একে ছয় সন্তানকে হত্যা করলেন। কিন্তু তার অন্তরের সব চেয়ে ভয় দেবকীর অষ্টম সন্তান। 

পিতা-মাতার সম্মুখে সন্তান হত্যার দৃশ্য কোন পিতা-মাতাই সহ্য করতে পারে না। তারপরও দেবকী ও বসুদেব তা সহ্য করে ভগবানের শ্রী চরণে সমস্ত দুঃখ নিবেদন করলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু রাজ পরিবারের অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য পিতা, ভাই, বন্ধু বা সমস্ত পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। 

কেননা তাদের অভিষ্ট সিদ্ধির জন্য অশুররা যা ইচ্ছা, যাকে ইচ্ছা হত্যা করতে পারে। স্বার্থের কমতি হলেই বন্ধু শত্রু হয়। স্বার্থ মানুষকে পশুর চরিত্রে রূপ দেয়। এ সংসারে মানুষই দেবতার রূপ নেয়। আজ সংসারে মানুষ দেবতার খুবই অভাব। তাই সংসারে অশান্তি আর অশান্তি সর্বত্র বিরাজ করছে। কংসের রাজ্যে সেই অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।

এদিকে, কারাগারে মাতা দেবকী ও বসুদেব প্রহর গুনছেন অষ্টম সন্তানের আগমন প্রতীক্ষায়। ভাদ্রের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি। বিশ্ব সংসারে সুসুপ্তিতে মগ্ন। আকাশ ঘনকালো মেঘের পরে মেঘ জমেছে। ঝটিকা বিক্ষুব্ধ রাত। সদ্য ভূমিষ্ট দেবকীর অষ্টম সন্তান শ্রী কৃষ্ণ। জননী দেবকী শিশুর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। নিঃশব্দ কান্নায় বুক ভেসে যাচ্ছে দেবকীর।

শিশু শ্রীকৃষ্ণকে রক্ষার জন্য দেবকী তার সন্তানকে তুলে দিলেন স্বামী বসুদেবের কোলে। বসুদেব শিশুকে নিয়ে যাত্রা করলেন গোকুলের দিকে। বৃষ্টি মাথায় যমুনা পেরিয়ে গোকুলে মা যশোদার আলয়ে রেখে এলেন শ্রীকৃষ্ণকে আর নিয়ে এলেন যোগমায়া রূপী শিশু কন্যা। শিশু কন্যাকে কংসের কারাগারে নিয়ে আসার পর ভোর হলো।

কংস শিশুর কান্না শুনে কারাগার থেকে শিশু কন্যাকে নিয়ে হত্যা করলেন। আকাশবাণী হলো, “হে মূঢ় কংস। তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িতেছে সে।” কেউ কেউ তর্ক করতে পারে যে, পরমেশ্বর ভগবান যিনি কেবলমাত্র দৃষ্টিপাত করার মাধ্যমে সমস্ত ঝড় সৃষ্টিকে প্রশমিত করেন, তিনি কেন দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হলেন? এখানে স্বয়ং ভগবানের মা হলেন দেবকী, সন্তানহারা আর ভক্তরূপী মা যশোদা সুকৃতির বলে হলেন ভগবানের পালক মাতা। নন্দালয়ে শুরু হয়েছে নন্দ উৎসব। 

সেই ক্ষণের সেই দিবসকে স্মরণ করে আজও সনাতনী হিন্দু সমাজ যথাযথ মর্যাদায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করে আসছে। শ্রীমদ্ভগবদ গীতার প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “পবিত্রানায় সাধু নং বিনাশায় দুস্কৃতাম ধর্ম সংস্থাপনায় সম্ভবামি যুগে যুগে।” 

আজকে এ যুগের কংস থেকে রক্ষা পেতে পরমেশ্বর ভগবান অনাদির আদি গোবিন্দ, সর্বকারনের কারণ শ্রীকৃষ্ণের ও শ্রী কৃষ্ণ ভক্তদের স্মরণ নিচ্ছে শান্তি প্রিয় সর্বজীব। আর সেই পরম শান্তির উদ্দেশ্যেই আজকের এই শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উৎসব। 

সর্বশেষে আজকের এই শুভদিন সুন্দর হোক এই প্রার্থনা জানাই। সবার মাঝে স্থাপিত হোক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।-----------হরে কৃষ্ণ।

লেখক-
রণজিৎ মোদক
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সভাপতি, ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব
ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ।
মোবা : ০১৭১১৯৭৪৩৭২
 

এই বিভাগের আরো খবর