শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে করুণদশা, বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকছেন ব্যাংকে

প্রকাশিত: ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০  

ইমতিয়াজ আহমেদ : সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতে এখন করুণদশা। বাড়ছে ব্যাংকের আমানত। ব্যাংক খাতে এখন আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রায় সমান। মূলত আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়া ও সঞ্চয়পত্র কেনায় কড়াকড়ি আরোপের ফলে ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে গত ৩০ মাসের মধ্যে আমানত প্রবৃদ্ধি এখন সবচেয়ে বেশি। 

 

গত বছরের শুরুতেও ব্যাংক খাতে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় দ্বিগুণ। ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধির কারণ হচ্ছে দুটি। এক. বিভিন্ন শর্তের কারণে সঞ্চয়পত্র কেনা বাদ দিয়ে নিরাপদ জায়গায় হিসেবে তারা ব্যাংকে টাকা রাখছেন। দুই. সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের সুদের হার বৃদ্ধি করেছে। 

 

তাছাড়া ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধি করতে সার্ভিস চার্জ কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত গড় আমানতকারীর অ্যাকাউন্ট থেকে হিসাব সংরক্ষণের জন্য কোনো সার্ভিস চার্জ আদায় করতে পারবে না ব্যাংকগুলো। এদিকে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা এখন অনেকাংশে ব্যাংকমুখী হয়েছেন বলে জানাগেছে। 

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিয়ন ব্যাংক লি. এর নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চ ম্যানেজার এমএম মাজহারুল ইসলাম (মিতু) দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার বিষয়টি পত্রিকায় পড়েছি। আমাদের ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে। সেটা সঞ্চয়পত্রের জন্য কিনা তা বোঝা মুশকিল। কারণ আমাদের ব্যাংকের স্কিকগুলো বেশ জনপ্রিয়। এগুলো হল; মাসিক মুনাফা ভিত্তিক প্রকল্প (লাখে ৮৫০ টাকা মুনাফা)। ডাবল বেনিফিট স্কিম (সাড়ে ৬ বছরে ডাবল)। হজ্ব স্কিম (মাসে ৫ হাজার টাকা করে ৫ বছরে হজ্বে যাওয়া যায় )।  কোটিপতি স্কিম ( ১০, ১২, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদী)। প্রতি মাসে ১৩ হাজার প্লাস টাকা জমা দিলে ২০ বছরে ব্যাংক একজন গ্রাহককে ১ কোটি টাকা দিবে। পেনশন স্কিম, ডিপিএস স্কিম ও মুদারাবাদ স্কিম আছে। 

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে, ইউনিয়ন ব্যাংক লি. এর নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চের মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫ হাজার। ব্যাংকের বয়স ৪ বছর। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আমানত সংগ্রহের ফ্লো ভাল ছিল। ব্যাংকের আমানত সংগ্রহের হার ১১% বেড়েছিল। ডিসেম্বরের পর থেকে একটু স্লো।

 


পূবালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার তেমন একটা প্রভাব পড়েনি। তবে কিছুটা এফেক্ট হয়েছে। আমাদের ব্রাঞ্চের সার্বিক পারফরমেন্স ভালো। আমাদের সবগুলো স্কিম জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেমন, পূবালী পেনশন স্কিম, সঞ্চয় স্কিম, মাসিক মুনাফা ভিত্তিক আমানত সংগ্রহ, স্বাধীন সঞ্চয় প্রকল্প, শিক্ষা সঞ্চয় প্রকল্প, দ্বিগুণ সঞ্চয় এবং এফডিআর। এই শাখার মোট গ্রাহক সংখ্যা ৮ হাজারের বেশি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য।

 

এবি ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমার কারণে কি না জানিনা, আমাদের কিছু ফান্ড বাড়ছে। তারল্য সংকট নিরসনে সহায়তা হচ্ছে। ২০১৯ সালের শেষ তিন মাসে ( সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর ) ১৫ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহের টার্গেট ছিল। আমরা ২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। ফলে ওই তিনমাসে আমাদের আমানত ৯ ভাগ বেড়েছিল। জানুয়ারি থেকে ফ্লো কমেছে। আমাদের জনপ্রিয় স্কিমগুলো হচ্ছে, তিন মাস মেয়াদী স্থায়ী আমানত সঞ্চয়, ডিপোজিট পেনশন স্কীম, মিলিয়নিয়ার স্কিম ও ডাবল স্কিম। মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি বলে অন্য একটি সূত্রে জানাগেছে।

 

ডাচবাংলা ব্যাংক লি. বঙ্গবন্ধু রোড শাখার একটি সূত্র জানায়, ব্যাংকের আমানতের হার বেশি। সঞ্চয়পত্রের সাথে মিল নেই। গ্রাহক সংখ্যা লাখের কাছাকাছি। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনছে। এদিকে, সিটি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চ সূত্রে জানাগেছে, সিটি ব্যাংকের গ্রাহক সেবার মান ভাল। তাই আমানত সংগ্রহ বাড়ছে। বিভিন্ন স্কিমগুলোও বেশ জনপ্রিয়। বর্তমানে ২০ হাজার গ্রাহক রয়েছে।


মার্কেন্টাইল ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চ ম্যানেজার  মো. শাহাদাত হোসেন খানের সাথে দেখা করলে তিনি অজানা এক ভয়ে কোন কথা বলতে রাজি হলেন না। সার্বিক বিষয়ে হেড অফিসে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন। তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, এই শাখার আমানত সংগ্রহের হার ভাল। কিন্তু গ্রাহক সেবা নিয়ে অনেকের অভিযোগ রয়েছে।

 

ইস্টার্ন ব্যাংক নারায়ণগঞ্জ ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের  সাথে দেখা করলে তিনিও কোন কথা বলতে রাজি হলেন না। নিজের নামটি পর্যন্ত তিনি বলতে চাননি। যুগের চিন্তার প্রতিবেদক তাঁর একটি ভিজিটিং কার্ড চাইলে তিনি কুকড়ে যান। সার্বিক বিষয়ে হেড অফিসে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন। তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, এই শাখার আমানত সংগ্রহের হার ভাল।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলা সঞ্চয় অফিসে ২০১৯ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির টার্গেট ছিল মোট ১৪৬ কোটি টাকা। ডিসেম্বর নাগাদ সঞ্চয় পত্র বিক্রি হয়েছে ৪১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। বিনিয়োগ কারীর সংখ্যা ৬২২ জন। মূল পরিশোধ করা হয়েছে ৪৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। গ্রাহকদের মুনাফা প্রদান করা হয়েছে ২২ কোটি ১১ লাখ টাকা। শতকরা ৫ ভাগ উৎস কর কর্তন করা হয়েছে ২ কোটি ১১ লাখ টাকা। 

 

সূত্রমতে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিরক্ষা পরিবার সঞ্চয়পত্র বিক্রির টার্গেট ছিল ৭৪ কোটি টাকা। বিক্রি হয়েছে ১৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ৩ মাস অন্তর স্কিমের বিক্রির টার্গেট ছিল ৪৮ কোটি টাকা বিক্রি হয়েছে ১৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ৫ বৎসর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র বিক্রির টার্গেট ছিল ১২ কোটি টাকা বিক্রি হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। পেনসনার সঞ্চয়পত্র বিক্রির টার্গেট ছিল ১২ কোটি টাকা বিক্রি হয়েছে ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।

 

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র মতে, গত কয়েক মাসে সারাদেশে সঞ্চয়পত্রের বিক্রির পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথমে জুন মাসে নারায়ণগঞ্জ জেলা সঞ্চয় অফিসে ২০১৯ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির টার্গেট ছিল মোট ১২৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা  অর্জিত হয়েছে ১৮০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বিনিয়োগকারীর টার্গেট ধরা হয়েছিল ১৫১ জন, সঞ্চয়পত্রে টাকা লগ্নি করেছেন ৩ হাজার ৫৮ জন বিনিয়োগকারী। মূল পরিশোধ করা হয়েছে ৮২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। গ্রাহকদেরকে মুনাফা প্রদান করা হয়েছে ৫৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। নীট বিনিয়োগ করা হয়েছে ৯৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। উৎসে কর কর্তন করা হয়েছে ২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

 

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানাগেছে, মূলত সঞ্চয়পত্রের কেনায় কড়াকড়ির কারণে এর বিক্রি কমে  গেছে। আর এখান থেকে বড় একটি অংশ ব্যাংকে আমানত হিসেবে টাকা রাখছেন। এ জন্য হঠাৎ ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধিতে বড় উল্লম্ফন হয়েছে। 


অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূলত চার কারণে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমছে। কারণগুলো হচ্ছে, এক. সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে কর সনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকা। দুই. ব্যাংক হিসাব খোলা। তিন. অনলাইনে আবেদন করা এবং চার. অর্থের উৎস সম্পর্কে বিবরণ দেওয়া।

 

উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের প্রথম দিন ১ জুলাই  থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে অনলাইন পদ্ধতি চালু হয়েছে। একইদিন থেকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে টিআইএন ও ব্যাংক হিসাব। এছাড়া একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৬০ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে না পারা এবং ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ হলেই উৎসে কর ১০ শতাংশ কেটে রাখার নিয়ম করার কারণেও বিনিয়োগকারীরা এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। 

 

তবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা বলছেন, গত ১ জুলাই থেকে অনলাইনে সঞ্চয়পত্র কেনা ও নগদায়নের জন্য অর্থ বিভাগ যে ‘জাতীয় সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করেছে, তারই ইতিবাচক ফল হচ্ছে এই বিক্রি কমে যাওয়া এবং এটাই তাঁরা চেয়েছিলেন।
 

এই বিভাগের আরো খবর