শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

স্রোতের বাইরে গেলে বাড়ে জনপ্রিয়তা

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৭ মে ২০২৩  


# ২০১১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দেশের প্রথম নারী মেয়র হন না.গঞ্জের ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী

# ২০২৩ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দেশের দ্বিতীয় নারী মেয়র হন গাজীপুরের গৃহবধূ জায়েদা খাতুন
 

সদ্য সমাপ্ত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাথে কাকতালীয়ভাবে অনেক মিল রয়েছে ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের। দুই নির্বাচনেই আওয়ামীলীগের শক্তিশালী প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। আর দুটি নির্বাচনেই বিএনপির প্রার্থী শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণে করেনি।

 

 

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র ও আওয়ামীলীগের সকল পদ থেকে বহিঃষ্কৃত নেতা জাহাঙ্গীর আলমের মা গৃহবধূ জায়েদা খাতুন জয়ী হয়েছেন। জায়েদা খাতুন টান টান উত্তেজনার নির্বাচনের আওয়ামীলীগের শক্তিশালী প্রার্থী এড. আজমত উল্লা খানকে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন।

 

 

আওয়ামীলীগের শক্তিশালী সকল পক্ষের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও একজন গৃহবধূর জনসমর্থনের জয় ঠেকানো সম্ভাবপর হলোনা। জায়েদা খাতুন দেশের দ্বিতীয় নারী হিসেেেব বাংলাদেশের একটি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।  

 

 

২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন গঠনের পর দেশের প্রথম নারী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ছাত্রজীবনে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও স্বামী সন্তান নিয়ে সুদূর নিউজিল্যান্ড প্রবাসী ছিলেন আইভী। দেশে ফিরে গৃহবধূ থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রার্থী হয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তবে সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত হন ত্যাগী আওয়ামীলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত আলী আহাম্মদ চুনকা কন্যা আইভী ২০১১ সালে। 

 

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা, প্রায় একযুগ আগে ২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সাথে ২০২৩ সালের গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পান। তারা বলছেন, ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমান বিএনপি প্রার্থী মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনের কাছে হারের পর বিদেশে পাড়ি জমান।  

 

 

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর দেশে ফিরলেও জনপ্রতিনিধি হিসেবে কোন দায়িত্বে ফেরার তখন সুযোগ ছিলনা শামীম ওসমানের কাছে। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে তখন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী। তাই শামীম ওসমানের কাছে সুযোগ আসে ২০১১ সালে যখন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন গঠিত হয়।

 

 

আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবেও তখন মনোনয়ন দেয়া হয় শামীম ওসমানকেই। তবে বিধি বাম। নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন মেয়র ও চুনকা কন্যা আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। স্থানীয় রাজনীতি তো বটেই জাতীয় রাজনীতি ছাপিয়েও এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সামনে আসে। বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান বর্তমানে বিএনপির সকল পদ থেকে বহিঃষ্কৃত নেতা তৎকালীন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এড. তৈমুর আলম খন্দকার।

 

 

তবে নির্বাচনের আগের দিন রাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে নির্বাচন থেকে সরে যান তৈমূর আলম খন্দকার। নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সর্বমহলের সমর্থন থাকার পরও আইভীর কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে যান বর্তমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ। এরপর দিন যত গড়িয়েছে আইভীর জনপ্রিয়তা ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামীলীগের টিকেটে তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন আইভী।

 

 

বিএনপি প্রার্থী না দিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আইভীর কাছে হারেন এড. তৈমূর আলম খন্দকার। দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙার অভিযোগে বিএনপির সদস্যপদসহ সকল পদ হারান তৈমূর।  এরআগে ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থী এড.সাখাওয়াত হোসেন খানকে পরাজিত করে নাসিকের মেয়র নির্বাচিত হন আইভী। 

 

 

রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হচ্ছে, প্রথাগত স্রোতের বাইরে গেলেই সাধারণ মানুষও অসাধারণ হিসেবে আবির্ভাব হয়। এর বাস্তব উদাহরণ প্রথমে তৈরি করেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। পরবর্তীতে দ্বিতীয় নজির গড়লেন গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন। বেফাঁস মন্তব্যের জেরে মেয়র থাকার পরও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃত্ব হারান জাহাঙ্গীর আলম।

 

 

ক্ষমা চেয়ে চেয়ে নানা জায়গায় ঘুরলেও তাতে কোন কাজে আসেনি। সর্বশেষ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তবে তার প্রার্থীতা বাতিল হয়ে যায়। নিজের সাথে তার মা জায়েদা খাতুনকেও প্রার্থী করেছিলেন। তার মনোনয়ন বৈধ হলেও কেউ ভাবতে পারেননি সাধারণ এক গৃহবধূ থেকে তিনি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নগরমাতা হতে পারবেন।

 

 

কিন্তু স্রোতের বাইরে যাওয়ার দুঃসাহস সবাই দেখাতে পারেননা। প্রথমে এটি দেখিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং পরবর্তীতে আবারও স্রোতের বাইরে যাওযার দুঃসাহস দেখালেন এক সাধারণ গৃহবধূ জায়েদা খাতুন। দুজনই বাজিমাত করলেন। আইভী হয়েছিলেন সারাদেশের প্রথম নারী মেয়র। আর গৃহবধূ জায়েদা খাতুন হলেন দেশের দ্বিতীয় নারী মেয়র। জায়েদা খাতুনের এই জয়ে দেশে নারী ক্ষমতায়নের আরেক দিকপাল উন্মোচিত হলো।  

 

 

আইভী আর জায়েদা খাতুনের সাথে আরেকটি জায়গায় মিল রয়েছে। আওয়ামীলীগের নৌকা বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হয়ে আইভী ছুটে গিয়েছিলেন গণভবনে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। ফুলেল নৌকা উপহার দিয়েছিলেন আওয়ামীলীগের সভানেত্রীকে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন।

 

 

গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনও ঠিক তাই করলেন। তবে একটু ভিন্নভাবে। দেশের বাইরে থাকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি হয়তো ছুটে যেতে পারেননি। তবে জয়ী হওয়ার পর জায়েদা খাতুন গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও শুভেচ্ছা। আমি ওনাকে ধন্যবাদ জানাই। ভোটটা আমার সুষ্ঠু হয়েছে। আমি আমার ভোটের হিসাব পেয়েছি।

 

 

এই জন্য আমি আরও ধন্যবাদ জানাই প্রধানমন্ত্রীকে।’ ‘এই বিজয় আমি গাজীপুরবাসীকে দেব এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দেব।’কাজটা যেহেতু আমি একা করতে পারব না। তাই আমার ছেলেকে নিয়ে করব, যে আগে থেকেই আমার পাশে ছিল। আমার ছেলের যে কাজগুলো বাকি ছিল, সেগুলো আমি শেষ করে দেব ইনশা আল্লাহ।’

 

 

জায়েদা খাতুন আরও বলেন, “আমার ছেলেকে সত্য প্রমাণের জন্যই আমার ভোটে আসা। কিছু কিছু লোক আছে, যারা যা করেছে, তাদের দিলেই (মনে) আছে। আমি গাজীপুরবাসীর জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টাই করব। আমার কাজ সবাইকে দেখিয়ে দেব।”  এন. হুসেইন রনী  /জেসি

এই বিভাগের আরো খবর