বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

হকার থেকে কোটিপতি পলিথিন জাকির

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৪ মে ২০২৩  



# তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে নেমেছে প্রশাসন


# নৌপথের চাঁদাবাজিতে একচ্ছত্র আধিপত্য


# চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রন করেন জাকিরের ছোট ভাই আল-আমি


এক সময়ে বাজারে বাজারে হেঁটে হেঁটে পলিথিন বিক্রি করে কোন রকমে জীবন যাপন করতেন পলিথিন জাকির। সময়ের ব্যবধানে তিনি আজ অর্ধশত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। তার রয়েছে একাধিক বাড়ি, গাড়ি, অঢেল সম্পত্তি। হাকিয়ে বেড়াচ্ছেন দামি গাড়ি ও কাটাচ্ছেন বিলাশী জীবন।

 

 

কিভাবে এত অল্প সময়ে বিপুল পরিমান অর্থবিত্ত ও অঢেল সম্পত্তির মালিক হলেন এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। জাকির হোসেন সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের কান্দারগাঁও এলাকার মৃত মমতাজ উদ্দিনের ছেলে। জীবন নির্বাহের তাগিদে একসময় মাছ বাজারে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি করত বলে এলাকায় তাকে ‘পলিথিন জাকির’ নামেই চেনে।

 

 

পরে মেঘনা ঘাটে হকারির পাশাপাশি এলাকায় বালু ভরাট ও জমি বিক্রির দালালিও চালিয়ে যান সমান তালে। পলিথিন জাকিরের উত্থানঃ উপজেলার কান্দারগাঁও এলাকার বাসিন্দা জাকির ওরফে পলিথিন জাকির জীবনের প্রথমে বৈদ্যেরবাজার এলাকার খেয়াঘাটে ‘মেসার্স পিয়াল এন্টারপ্রাইজ’ নামে বৈদ্যেরবাজার থেকে মেঘনাঘাট পর্যন্ত ইজারা নেন জাকির।

 

 

অতিরিক্ত চাঁদাবাজির কারণে তার ইজারা বাতিল করা হলে পুনরায় ‘কান্দারগাঁও যুব কল্যাণ সমিতি’র নামে আবারও ইজারা নেন। একই অভিযোগে তা আবারো বাতিল হলে পুনরায় ইজারা পায় কান্দারগাঁও গ্রামের একতা সংঘের সভাপতি আমজাদ হোসেন। কিন্তু ইজারার নিয়ন্ত্রণ থাকে জাকিরের হাতেই। ইজারা বাতিল হলেও জোরপূর্বক নৌপথে চাঁদাবাজি করতেই থাকে পলিথিন জাকির।

 

 

সোনারগাঁ উপজেলায় নৌপথের চাঁদাবাজির একচ্ছত্র অধিপতি বনে যান জাকির ওরফে পলিথিন জাকির। ‘সোনারগাঁ রিসোর্ট সিটি’ নামে একটি আবাসন প্রকল্পের জমি ক্রয় ও বালু ভরাটের দায়িত্ব পেয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন জাকির। সাধারণ মানুষের জমি দখল, ভুয়া দলিলে জমি বিক্রি এবং বালু ভরাটের টেন্ডারবাজি করার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

 

 

জাকিরের নেতৃত্বে মেঘনা নদীতে চলাচলরত বিভিন্ন নৌযান থেকে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপের প্রতিবাদে এলাকাবাসী কয়েকদফা মানববন্ধন করলেও কোন প্রতিকার পায়নি। নৌযান থেকে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে জাকিরের সন্ত্রাসী বাহিনীর ২০-২৫ জনের একটি দল।

 

 

প্রতিদিন তিন, চারটি ইঞ্জিন চালিত নৌকার মাধ্যমে ৬/৮ জন সন্ত্রাসী মিলে দেশীয় অস্ত্র ও লাঠি সোটা নিয়ে নৌপথে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রন করেন জাকিরের ছোট ভাই আল-আমিন। এলাকাবাসী জানান, নৌ-চাঁদাবাজি, সাধারণ মানুষের জমি দখল, ভুয়া দলিলে জমি বিক্রি এবং বালু ভরাটের টেন্ডারবাজি করে পলিথিন জাকির সম্পদের পাহাড়, কান্দারগাঁও এলাকায় বিশাল বহুতল ভবন নির্মাণ, তার পাশেই দশবিঘা জমির মধ্যে সেনতুসা নামে একটি রিসোর্ট ও অত্যাধুনিক শপিংমল তৈরি করেছেন।

 

 

এছাড়া কান্দারগাঁও এলাকায় নামে বেনামে আরো বিঘায় বিঘায় জমি রয়েছে তার। ঢাকার বনশ্রীতে আলিশান বাড়ি, নীলা সুপারসপ নামে বিশাল সুপারসপসহ ঢাকার আবাসিক এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে তার। বর্তমানে তিনি অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। দুটি হত্যা ও নৌ-চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ও মারামারিসহ প্রায় ডজনখানেক মামলার আসামি পলিথিন জাকির।

 

 

২০১২ সালে রিপন হত্যা, ২০১৪ সাথে সাধন হত্যা ও ২০১৫ সালে গোলজার হত্যা মামলার আসামী ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি খুন হয় জাকিরের সকল অপকর্মের সাক্ষী ভাগিনা মোহাম্মদ আলী। সেনতুশা রিসোর্টের নামে কান্দারগাঁও এলাকায় গড়ে তোলা কয়েকটি কক্ষ নির্মাণ করে সেখানে অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।

 

 

উঠতি বয়সের শিক্ষার্থী, যুবক, যুবতিরা ঘন্টার পর ঘন্টা এই রিসোর্টের কক্ষে সময় কাটাচ্ছেন। এতে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সুষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসীর আরো অভিযোগ, সূচতুর জাকির তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সাধন এবং ভাগিনা মোহাম্মদ আলীকে হত্যার আগে পরিকল্পিতভাবে অন্যকে ফাঁসিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের জন্য খুন হওয়ার দু-এক দিন আগে সোনারগাঁ থানায় তাদের নিরাপত্তা চেয়ে সে নিজে বাদী হয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন।

 

 

ডায়েরি করার দুই দিন পর সাধন এবং একদিন পর মোহাম্মদ আলী নৃশংসভাবে খুন হয়। স্থানীয়দের মধ্যে চাউর রয়েছে, পলিথিন জাকিরের ভাগিনা মোহাম্মদ আলী হত্যা মামলার ভয় দেখিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে বলেও জানা যায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে মার্চ মাসে সোনারগাঁ উপজেলা যুবলীগ সম্মেলনের মাধ্যমে তৎকালীন দুটি হত্যা মামলাসহ প্রায় ডজন খানেক মামলার আসামি পলিথিন জাকিরকে পিরোজপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হিসেবে নাম ঘোষণা করেন।

 

 

সেই থেকে আওয়ামী যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন জাকির ওরফে পলিথিন জাকির। যুবলীগের কমিটিতে পিরোজপুর ইউনিয়ন সভাপতি হওয়ার পর আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও কেন্দ্রী নেতার সাথে তার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল করে প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে অবৈধ সুবিধা আদায় করেন। সে সময় বৈদ্যের বাজার খেয়াঘাটের ইজারা পাওয়ার পর তার বাহিনীর চাঁদাবাজি ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক মাঝি ও গ্রামবাসী আনন্দ বাজারে চলে গেছেন।

 


এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোশাররফ হোসেন জানান, এক সময়ের যার পরিচয় দেওয়ার মতো কিছুই ছিলনা সময়ের ব্যবধানে আজ সে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক। নদী পথে চাঁদাবাজি, হত্যার পর হত্যা সর্বশেষ ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হয়ে পলিথিন জাকির আজ এক অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।

 


এ ব্যাপারে অভিযোগের বিষয়ে জাকিরের বক্তব্য জানতে ফোন দিলে তিনি জানান, একটি মহল তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও অসৎ উদ্দেশ্যে এবং হিংসার বশবর্তী হয়ে এই অপপ্রচার করছে। মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি জামিনে আছি।

 


এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম সুমন জানান, জাকির হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামী ছিলেন। বর্তমানেও এলাকায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তার বিষয়ে খোজখবর নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

 


এ বিষয়ে নারায়নগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জুর হাফিজ জানান, অপরাধীরা যেই দলের বা যতই প্রভাবশালী ব্যক্তিই হউক না কেন তাদেরকে কোন অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া হবে না। জাকিরের অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

 


র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক তানভির মাহমুদ পাশা জানান, যুবলীগ নেতা জাকিরের মামলার বিষয়ে খোজখবর নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এন.হুসেইন রনী /জেসি