শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

৩ নভেম্বর গার্মেণ্টস ট্র্যাজিডি : নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক অভ্যত্থান

এড. মাহবুবুর রহমান ইসমাইল

প্রকাশিত: ২ নভেম্বর ২০২০  

তৈরি পোশাক শিল্প শ্রমিকদের মজুরী নিয়ে ঘুরাঘুরি, মজুরী কম দেওয়া এবং শ্রম আইন উপেক্ষা করা এ শিল্প মালিকদের একটি সাধারণ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

 

বিগত ২ দশকের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শ্রমিকদের অসন্তোষ যখন ভয়াবহ বিদ্রোহের আকারে দেশকে অচল করে দেওয়ার মতো উপক্রম হয়, মুলতঃ তখনই সরকার ও মালিকপক্ষের ঘুম ভাঙ্গে। 


আজ থেকে ১৭ বছর আগে নীট ওয়্যার গার্মেণ্টস শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কর্মদিবস হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হত। শ্রমিকদের মানুষ হিসাবে গণ্য করা হতো না, তাদের সাথে ক্রীতদাসের মতো আচরণ করা হতো।

 

অমানবিক শোষণ নির্যাতনের কারণে শ্রমিকদের মধ্যে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ২০০৩ সালের ৩রা নভে¤¦র, নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, বিসিক শিল্প নগরীতে।


    ২রা নভে¤¦র ২০০৩ মধ্যরাত, ফতুল্লা বিসিকে, প্যানটেক্স ড্রেস লিঃ গার্মেণ্টেসের গেইটে অবস্থান ধর্মঘটরত শ্রমিকদের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হলো, হঠাৎ সেখানে ৩ জন ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হয়ে মালিকের শিপ্মেণ্ট খালাস করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে।

 

এজন্য তারা আন্দোলনরত শ্রমিকদের সাথে নানা প্রকার আশ্বাস দিতে থাকে। অতীতে মালিকদের আশ্বাসের নামে ধোঁকাবাজির অভিজ্ঞতা এবং অবিশ্বাসের কারণে আন্দোলনকারী শ্রমিকরা আমার উপস্থিতি ছাড়া মালিক প্রশাসনের সাথে কোন বৈঠক করতে রাজি না হওয়াতে, রাত সোয়া ১১ টায় মোবাইলে ওসি, ফতুল্লা আমাকে বলেন আন্দোলরত শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান করার জন্য তারা আমাকে সহ বসতে চায়।

 

ওসি, ফতুল্লাকে বলি, আগের দিন বিকাল ৫ টায় মালিক শ্রমিক দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে শ্রমিকদের পক্ষে আমি ছিলাম। শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিটি মেনে না নেওয়ার কারণে সমস্যার সমাধান হয়নি।

 

তখন ঐ পুলিশ অফিসার অধিক আগ্রহে আমাকে বলেন, আপনি যদি এখন আসেন, তবে পুনরায় আলোচনা করে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস সহ ১৮ দফা দাবি নিশ্চিত সমাধান করা হবে। তার সামনে বসা তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট (এন.ডি.সি) সৈয়দ বেলাল হোসেন, মানজারুল মান্নান ও প্রকাশ কান্তি তাদের নাম পরিচয় দিয়ে, তারা আমার সাথে কথা বলেন।

 

মালিক ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবি এখন মেনে নিয়েছে। তখন তারা আর দেরি না করে আমাকে বিসিকে আসার জন্য অনুরোধ করলেন এবং আরো জানালেন ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস সহ ১৮ দফার চুক্তিনামাটি কম্পিউটারে টাইপ করা হচ্ছে। তারা আমার জন্য গাড়ি পাঠাতে চাইলে আমি বলি দরকার নেই।

 

সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিষয়টি অবহিত করে আমি রাত প্রায় সাড়ে ১২ টায় রিকশায় বিসিকে রওনা দেই। এমনিতেই ছিল শীতের কুয়াশা, আবার রমজান মাসের কারণে বিসিকের অধিকাংশ কারখানার বাতি নেভানো থাকায় চারদিক ছিল অন্ধকার। তখন প্যানটেক্স গার্মেণ্টস এর গেইটের শ্রমিকেরা রাত দিন লাগাতারভাবে ৩ দিন যাবৎ শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান ধর্মঘট পালন করে আসছিল। 


এদিকে বিসিকের চারদিকে বিভিন্ন কারখানায় আন্দোলনের উত্তাপ তখন ক্রমশঃ বেড়ে চলছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনমুখী এই টগবগে অবস্থা গার্মেণ্টস মালিক পক্ষ কখনো কেয়ার করার প্রয়োজন মনে করেনি। উপরন্তু নিজেকে স্বরাষ্ট্র সচিবের আত্মীয় মিথ্যা পরিচয় জারি করে, সরকারি দল ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে, উক্ত মালিক বেপরোয়া মারমুখী হয়ে উঠেন।

 

শ্রমিকদের উপরে দমন-পীড়ন খুবই বাড়িয়ে দেয়, এমনকি রমজান মাসে শ্রমিকদের নামাজের সময় অযুর পানির কল পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়, এতে শ্রমিকেরা আরো উত্তেজিত হয়ে উঠে।


আমি সেখানে গিয়ে টেলিফোনে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুশিল কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে কথা হয়েছে, তা কারখাার গেইটের সামনে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে সবকিছু অবহিত করি।

 

প্যানটেক্স গার্মেণ্টসে খবর নিয়ে জানতে পারি ভিতরে কেউ নেই, মালিক পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটরা পার্শ্ববর্তী এমভি গার্মেণ্টসের ৭ তলায় বসে আছে। নেতা পর্যায়ের কয়েকজন গার্মেণ্টস শ্রমিককে সংগে নিয়ে আমি সেখানে যাই। মালিক কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের কর্তারা আমাকে বলে, দাবি-টাবি পরে দেখা যাবে, আজকে শ্রমিকদের আন্দোলন বাদ দিয়ে চলে যেতে বলেন।

 

আমি তাদের বলি, এটা আমার দ্বারা বলা সম্ভব নয়। কারণ, কথা অনুযায়ী কাজ না হলে, আমি শ্রমিকদের কিছু বলতে পারবো না। এ সময়ে ম্যাজিস্ট্রেট, মালিক ও তাদের কয়েকজন মাস্তান সবাই আমার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে উগ্র ভাষায় কথাবার্তা বলতে থাকে, এক পর্যায়ে তারা মাতালের মতো বেপরোয়া আচরণ শুরু করে, আমাকে নরমে-গরমে হুমকি গালি-গালাজ করতে থাকে।

 

পিস্তল শো-করে এ সময়ে তারা আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। রাত ২ টার দিকে ৭ তলা থেকে আমাকে সহ নিচে নামতে বাধ্য করে ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে মালিক ও পুলিশের কর্তারা শ্রমিকদের অবস্থান ধর্মঘটের স্থানে যেয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন বাদ দিয়ে চলে যেতে বলে।

 

শ্রমিকরা বলে, যে মালিক কিছুক্ষণ আগে এক কথা বলে ২ ঘণ্টার মধ্যে সে কথা পাল্টিয়ে ফেলে, তাকে বিশ্বাস করা যায় না। শ্রমিকেরা তাদের দাবির ব্যাপারে আরো অনড় হয়ে উঠে। এবার ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের কর্তারা সরাসরি মালিকের পক্ষ নিয়ে শিপ্মেণ্ট খালাশ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।

 

ম্যাজিস্ট্রেট বেলাল হোসেন চোখ লাল করে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে সরাসরি হুমকি দিয়ে বলে, আন্দোলন বাদ না দিলে শ্রমিকদের লাশের উপর দিয়ে তারা শিপ্মেণ্ট করাবে। সুতরাং এটা পরিস্কার যে, শুরু থেকেই মালিক প্রশাসন আলোচনা নয়, দমন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছিল। রাত ৩ টার দিকে পুলিশ আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়।

 

কারণ জানতে চাইলে তারা আমার উপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এরপরে আমার বিরুদ্ধে কোন মামলা বা অভিযোগ না থাকার পরেও ভোর সোয়া ৫ টার দিকে আমাকে গ্রেফতার করে একটি মাইক্রোবাসে করে ফতুল্লা থানায় নিয়ে যায়।

 

সকাল পৌনে ৬টায় বন্দি অবস্থায় থানার ওয়্যারলেস সেটে বিসিকে গুলির শব্দ শুনতে পাই। পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র আন্দোলনরত অসহায় শ্রমিকদের উপর। মিনিটে -মিনিটে গুলির আওয়াজ শুধু বাড়তেই থাকে। এস.পি ওয়ারল্যাস সেটের মাধ্যমে একের পর এক হত্যাকান্ডের সবরকম সতর্কমূলক নির্দেশনা দিতে থাকে।

 

এই সময়ে থানায় ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে ভেসে আসতে থাকে শ্রমিকদের আর্তচিৎকার। নারকীয় আক্রমনে তখনই গুলিতে নিহত হন প্যানটেক্স গার্মেণ্টসের শ্রমিক নেতা আমজাদ হোসেন কামাল। প্রায় ২ শত শ্রমিক গুলিবিদ্ধ এবং বহু শ্রমিক নিখোঁজ হয়ে যায়।


মুহুর্তের মধ্যে প্রতিরোধের আগুন আগ্নেয়গিরির মতো তীব্র গতিতে পুরো শহর প্রক¤িপত করে তোলে। শহরের চতুর্দিকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অনবরত মিছিলের পর মিছিল চলতেই থাকে। প্রতিরোধের মিছিল যেন শেষ হতে চায় না। একটানা চারদিন নারায়ণগঞ্জ প্রশাসনের অত্যাচারের খড়গ দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙ্গে পড়ে যায়, রাজপথ তখন করে নেয় বিপ্লবী গার্মেণ্টস শ্রমিকেরা।


অবশেষে সরকারীভাবে গঠিত ১ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত না হওয়ায়, গত ২৭ মার্চ ২০০৪ইং নারায়ণগঞ্জের এক নাগরিক সমাবেশে ড. কামাল হোসেন সাবেক বিচারপতি জনাব হাবিবুর রহমান খানকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট গণতদন্ত কমিশন ঘোষনা করেন।‘
  

ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার দেয়া হয় নাঃ শ্রমিকেরা যেন তাদের দাবির কথা বলতে না পারে এবং মালিকদের জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে কেউ যেন প্রতিবাদ করতে না পারে, সেজন্য মালিকেরা নানা অজুহাত দেখিয়ে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠণ করতে দেয় না। মালিকদের অসহনীয় জুলুম নির্যাতনে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ৩রা নভে¤¦র একটি বিস্ফোরণ মাত্র।
  

নারায়ণগঞ্জে ৩রা নভে¤¦র শ্রমিক অভ্যূত্থান বিপ্লবী সংগ্রামের একখন্ড ইতিহাস, দীর্ঘদিন মার খাওয়া শ্রমিকেরা আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে। রাজপথে শ্লোগানের ধ্বনিতে প্রতিবাদের ভাষা নিজেদের অস্তিত্বের শক্তিকে অনুভব করতে শিখেছে।

 

একবার মা ডাক শিখে যে শিশু, সে ডাক আর ভুলে না, তেমনি দুনিয়ার মজদুর এক হও শ্লোগান একবার যে শ্রমিক শিখেছে সে কখনো আর ভুলবে না। শহীদ আমজাদ হোসেন কামালের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। 

 

লেখক-
সভাপতি
বাংলাদেশ টেক্সটাইল-গার্মেণ্টস শ্রমিক ফেডারেশন

এই বিভাগের আরো খবর