শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪   শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

ফুটপাত দখলে মরিয়া চাঁদাবাজচক্র 

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  

 

# ফুটপাতে চাঁদাবাজি করে গ্রুপের অনেকে হয়েছেন কোটিপতি

 

 

নারায়ণগঞ্জ শহরে ফুটপাত মানে যেন সোনার হরিণ। মার্কেটের দোকান ফেলে রেখেও অনেকে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করছে এমন নজির ভুরিভুরি। সিটি কর্পোরেশনের দেয়া হকার্স মার্কেটের দোকান বিক্রি করে আবারো ফুটপাত দখল করেছে একটি চক্র। কোটি টাকার চাঁদাবাজি নিয়ে এই চক্র এতোটাই সুবিস্তৃত যে সিটি মেয়র, সাংসদ, সাংবাদিক, প্রশাসনসহ সুশীল সমাজের কথা কিংবা সিদ্ধান্তকেও তোয়াক্কা করে না এরা।

 

গত ৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাব আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে নারায়ণগঞ্জের ফুটপাতগুলোতে হকার না বসতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রশাসন হকারদের ফুটপাতে বসতে দিচ্ছে না। তবে ফুটপাতের এই হকাররা এতোটাই বেপরোয়া পুলিশ দেখলে মালামাল নিয়ে তারা খোলা রাস্তায় দৌঁড় দেয়। এতে অনেক পথচারী তাদের এই দৌঁড়াদৌঁড়িতে পড়ে গাড়ির নিচে পড়ে আহত কিংবা নিহত হতে পারে। শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের বিভিন্ন গলির মধ্যে তারা ফুটপাতে বসার সরঞ্জামাদি লুকিয়ে রাখে।

 

সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি আগে এসব সরঞ্জামাদি আটক করতো। তবে এবার তা চোখে পড়েনি। ফুটপাতে এই হকাররা কোটি টাকার বিদ্যুৎ চুরি করে অবৈধ সংযোগে ব্যবসা করতো। এসব বিদ্যুতের লাইনও ওভাবে পড়ে থাকায় বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে সূত্র জানিয়েছে, হকার না বসার যে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা মানতে নারাজ কথিত হকার নেতারা। তারা কখনো এমপি শামীম ওসমান আবার কখনো প্রশাসনের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন।

 

এসব হকার নেতার মধ্যে আসাদের নামে তো হত্যা মামলা রয়েছে। ফুটপাতে বসা নিয়ে সাধু পৌলের গির্জার সামনে ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এদিকে  হকার বসতে না দেয়ায় ওই নেতাদের শেল্টারে আরো বড় ধরণের হট্টগোল ও নৈরাজ্য তৈরির পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছে সূত্র। 

 

হকারদের ওই গ্রুপের একাধিক সদস্য জানান, মার্চের শুরু থেকে হকাররা যে কোন মূল্যে ফুটপাতে বসার চেষ্টা করবে। তখন শহরের চাষাঢ়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে একাধিক সমাবেশ করবেন। সেখানে ঢাকা থেকে পরিচিত শ্রমিক নেতাদের আনার চেষ্টা করা হবে যাতে তাদের বক্তব্য গণমাধ্যমে ফোকাস হয়। এছাড়া সমাবেশের পর মেয়র, এমপি, জেলা প্রশাসকের কাছে আলাদা স্মারকলিপি দিবে হকার নেতারা। স্মারকলিপির পরেও হকার বসতে না দিলে চাষাঢ়ায় কাফনের কাপড় পরে আত্মাহুতি কিংবা চাষাঢ়ায় সড়কে বসে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।

 

হকার নেতাদের মতে, তারা যে কোনভাবেই চাইবে রোজার সময়ে যেন নিয়ম করে হলেও ফুটপাতে বসতে পারে। কারণ রোজার সময়ে তাদের বেচাকেনা ভালো হয়। রোজায় যেন ফুটপাতের একটি অংশে মানুষের পায়ে হেঁটে যেতে পারে সেটা কার্যকর করেই যেন দোকানদারী করা যায়। এ ক্ষেত্রে হকার নেতারা যে কোন ধরনের শর্ত মানবে জানিয়ে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হবে।

 

হকাররা জানান, এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়ারও পরিকল্পনা চলছে। সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীকে ‘মানবতার মা’ আখ্যা দিয়ে আবেগঘন স্মারকলিপি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সেটা লেখারও প্রস্তুতি চলছে। স্মারকলিপি দিলেও আন্দোলন হলে রোজার মাসে অন্তত হকাররা বসতে পারবে তাদের ধারণা।

 

সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জে বঙ্গবন্ধু সড়কসহ অন্যান্য সড়কে চাঁদাবাজি করার জন্য হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে আসছে হকার সংগ্রাম পরিষদ যার সভাপতি হলেন রহিম মুন্সি ও সাধারন সম্পাদক হলেন আসাদ। কিন্তু সেই ফুটপাতে প্রশাসনের চোখের সামনে প্রতিদিন লাখ টাকার উপরে চাঁদা বাজি করতো। যার নেতৃত্বে দিয়ে অসছে হত্যা মামলা ও মেয়র আইভীর উপরে হামলার মামলা সহ প্রায় তিনটি মামলার আসামী নামর্ধারী হকার নেতা আসাদ ও রহিম মুন্সি।

 

শহরের চাদাঁবাজি করার জন্য বট গাছের মত শাখা-প্রশাখা। যা শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রেখেছে রহিম মুন্সি ও আসাদ। তাদের মাঝে অনেকে আগে প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভ্যানগাড়ীতে করে এয়ার ফোন ও একশ টাকার নিচে বিভিন্ন খেলনা বিক্রি করতো। কিন্তু বর্তমানে ফুটপাত থেকে চাদাঁবাজি করে গড়েছেন একাধিক জায়গা ও দামি গাড়ি সহ নানা সম্পদ।

 

নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধানের জন্য গত শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের আয়োজনে শহরের যানজট ও ফুটপাত দখল সমস্যা সমাধানে এক গোল টেবিল বৈঠকের অনুষ্ঠিত হয়। যাতে নারায়ণগঞ্জ এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, র‌্যাব-১১ অধিনায়ক সহ সকলে মিলে নারায়ণগঞ্জ শহরের হকার ও যানযট মুক্ত করার ঘোষণা দেন।

 

তারপর থেকেই শহরে প্রধান প্রধান সড়ক গুলোতে থাকা সকল ধরনের অবৈধ স্থাপনা, সড়কের দুইপাশে ফুটপাতের জায়গা দখল ও চাষাড়া মোড়ে অবৈধ গাড়ির স্ট্যান্ডসহ সকল অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্দে একশ্যানে নামে প্রশাসন। তার পর থেকেই রহিম মুন্সি ও আসাদের নেতৃত্বে পুনরায় বসার পায়তারা করে আসছে। প্রায় ৫ দিন ধরে ফুটপাতে হকার না থাকায় তাদের চাঁদাবাজিতে অনেকটা বাধা পড়েছে। তাই সকলকে এক করে আবার একটি ঝামেলা তৈরি করার জন্য তৈরি হচ্ছে আসাদ বাহিনী।

 

সুত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ শহরে রামরাজত্ব তৈরি করে ফুটপাত দখল করে আছে প্রায় ৫ হাজার হকার। অভিযোগ রয়েছে, হকার নেতা রহিম মুন্সি ও হকার জোবায়ের হত্যা মামলার অন্যতম আসামী হকার আসাদ এর নেতৃত্বে রয়েছে বিশাল এক চাঁদাবাজ বাহিনী। নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রধান সড়ক বঙ্গবন্ধু রোডের চাষাড়া এলাকা থেকে ২ নাম্বার রেলগেট হয়ে ডিআইটি পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে অবস্থান করেন হাজার হাজার হকার। এর মধ্যে জামা কাপড়, জুতা, ক্রোকারিজ, মসলা আর শুঁটকির দোকান থেকে শুরু করে যৌনবর্ধক নিষিদ্ধ ওষুধের দোকান পর্যন্ত বসানো হয়েছিল ফুটপাত দোকান।

 

সূত্রমতে জানা যায়, ফুটপাতে চাঁদা আদায়ে সাথে জড়িত প্রায় ১০/১৫ জন্য তবে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, রহিম মুন্সি, আসাদুজ্জামান আসাদ, আলমগীর হোসেন পলাশ, ভান্ডারী, হারুন মিয়ার ছেলে দারুন, আরিফ ও সোহেল। এসব চাঁদাবাজরা কমপক্ষে বছরে ২ কোটি ৫ লাখ টাকা শহরের ফুটপাত থেকে আদায় করতো।

 

নারায়ণগঞ্জ হর্কাসলীগের সভাপতি রহিম মুন্সি শহরের চাষাড়াস্থ হর্কাস মার্কেট থেকে বঙ্গবন্ধু সড়কের আমান ভবন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন।এই সড়কের পূবদিক ২৫০ এর অধিক হকারের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন দোকান প্রতি ৫০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে প্রতিদিন আনুমানিক ১২ হাজার ৫শ টাকা এবং মাসে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা চাঁদা আদা করে থাকে। বছরে চাঁদা আদায় হয় ৪৫ লাখ টাকা। হর্কাস সংগ্রাম পরিষদের আহব্বায়ক আসাদুজ্জামান আসাদ নিয়ন্ত্রণ করেন বঙ্গবন্ধু সড়কের গলাচিপা থেকে চাষাড়া মার্ক টাওয়ার পর্যন্ত।

 

এ সড়কে আনুমানিক ১৫০ টি হকারের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন দোকান প্রতি ৫০ টাকা করে যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৫শ টাকা। মাসে চাঁদা আদায় হয় ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ২৭ লাখ টাকা। আলমগীর হোসেন পলাশ নিয়ন্ত্রণ করেন ২ নং রেলগেইট থেকে ১ নং রেলগেইট পর্যন্ত। ফজর আলী মার্কেট থেকে উৎসব বাস কাউন্টার পর্যন্ত চেম্বার রোড সড়কের রেল লাইনের পাশে ১০০ টির অধিক দোকান। দক্ষিণ পাশে ২ শতাধিক হকারদের দোকান রয়েছে।

 

উত্তর পাশের প্রতি দোকান থেকে প্রতিদিন ১০০ টাকা করে ১০ হাজার টাকা দক্ষিণ পাশে ২০ টাকা করে ৪ হাজার টাকা করে মোট দৈনিক আদায় হয় ১৪ হাজার টাকা। মাসে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ভান্ডারী নিয়ন্ত্রণ করেন নারায়ণগঞ্জ উৎসব কাউন্টার থেকে বন্দর সেন্ট্রাল খেয়াঘাট পর্যন্ত। এই এলাকায় আনুমানিক ৮০ টি হকারের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন ৩০ টাকা করে দৈনিক ২ হাজার ৪শ টাকা। মাসে ৭২ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করেন। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।

 

ক্ষমতাসীন দলের লোক পরিচয় দিয়ে ‘দারুন’ নিয়ন্ত্রন করেন বর্ষন সুপার মার্কেট থেকে পূর্বপাড়ের করিম মার্কেট পর্যন্ত আনুমানিক ৫০ টির অধিক দোকান রয়েছে। প্রতিদিন দোকান প্রতি ৩০ টাকা করে দৈনিক ১৫শ টাকা। মাসে ৪৫ হাজার টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ২নং রেল গেইট পুলিশ বক্সের পুলিশ পরির্দশক সুরুজ মিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন মন্ডলপাড়া থেকে নগর পাঠাগার পর্যন্ত। তিনি এই সড়কের আনুমানিক ২০ টি ভ্যান গাড়ির দোকান থেকে প্রতি সপ্তাহে ভ্যান প্রতি ২০০ টাকা করে মাসে ১৬ হাজার টাকা ব্যক্তিগতভাবে আদায় করেন।

 

বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ২ লাখ টাকা। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের গলি থেকে পপুলার হাসপাতালের গলি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগ পরিচয়দানকারী আরিফ। সে তার চতুর্থ স্ত্রী হত্যা মামলায় পলাতক আছেন। এখানে দোকান বসে সব মিলিয়ে ১শ টির মতো। দোকান প্রতি চাঁদা তোলা হয় ১শ টাকা করে। দৈনিক ১০ হাজার টাকা হিসেবে মাসে উঠানো হয় ৩ লাখ টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৩৬ লাখ টাকা। কালীবাজার ব্যাংক মোড় থেকে ফ্রেন্ডস মার্কেট পর্যন্ত চাঁদা তোলেন সোহেল। এখানে দোকান আছে ১৫০টি।

 

৫০ টাকা করে টাকা দৈনিক ৭ হাজা ৫শ টাকা চাঁদা উত্তোলন করে থাকে। মাসে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বছরে চাঁদা আদায় করা হয় ৩০ লাখ টাকা। তারাই পুরো হকার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ করতেন, এবং সামনে হকারদের নিয়ে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও নারায়ণগঞ্জের সুশীলদের নেয়া সিদ্ধান্তের বিপক্ষে গিয়ে নগরবাসীকে কষ্ট দেয়া জন্য হকার বসানোর দাবি তুলে রাস্তায় নামতে পারেন। এরআগেও তারা প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধু সড়কে টায়ার, কাঠে আগুন জ্বেলে রাস্তা অবরোধ করে হকার বসানোর জন্য মরিয়া হয়ে নেমেছিলেন। তবে নগরবাসীর দাবি এসব শক্তহাতে দমন করবে প্রশাসন। এস.এ/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর