রোববার   ১৯ মে ২০২৪   জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

বজলুর বেপারোয়া হওয়ার পেছনে,স্থানীয় সংসদ সদস্যকে দুষছেন চনপাড়াবাসী

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২১ নভেম্বর ২০২২  


# ডন বজলুর উত্থানে নেপথ্যে রাজনীতি

# তিন মামলায় বজলু ছয় দিন রিমান্ডে; চনপাড়ায় উচ্ছ্বাস, মিষ্টি বিতরণ
 

 

আতঙ্ক এখনো কাটেনি, তারপরও আর আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দারা। যে মানুষটির কারণে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দুর্বিষহ দিনযাপন করছিলেন চনপাড়ার মানুষ, সেই কুখ্যাত বজলুর রহমান ওরফে ডন বজলু গ্রেপ্তার হওয়ার পরও সংশয়ে ছিলেন ভুক্তভোগীরা।

 

 

কিন্তু গতকাল রবিবার বজলুর ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের খবর পাওয়ার পর চনপাড়ার মানুষের উচ্ছ্বাস বাধ ভেঙেছে। মিষ্টি বিতরণ করে নিজেদের আনন্দ প্রকাশ করেছেন চনপাড়ার মানুষ। বজলুর বিচার দাবিতে বিশেষ মোনাজাত করে দোয়া মাহফিলও করেছেন তারা।

 



এর আগে গতকাল তিন মামলায় দুইদিন করে বজলুর মোট ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট কাউসার আলমের আদালত। এর আগে রূপগঞ্জ থানায় বজলুর বিরুদ্ধে ওই তিনটি মামলা দায়ের করে র‌্যাব। এসব মামলায় রিমান্ড শুনানির জন্য গতকাল কড়া নিরাপত্তায় বজলুকে আদালতে হাজির করা হয়।

 



র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন জানান, “শুক্রবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র (চনপাড়া বস্তি) এলাকার চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি বজলুর রহমান ওরফে বজলুকে গ্রেপ্তার করা হয়।

 

 

বস্তির প্রায় ২০০টি স্পটের মাদক কারবারিদের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে টাকা তুলত তার সিন্ডিকেট। এ পর্যন্ত মাদকসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বজলুর বিরুদ্ধে ২৩টি মামলার রেকর্ড পেয়েছে র‌্যাব। সম্প্রতি চনপাড়ায় অভিযানে যাওয়া র‌্যাব এর সদস্যদের ওপর হামলার মামলার প্রধান আসামিও এই বজলু।

 



এদিকে বজলুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের তিন নম্বর ওয়ার্ডের খেলার মাঠে সভা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বজলুকে গ্রেপ্তার করে চনপাড়ায় শান্তি ফেরানোয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তারা।

 

 

এ সময় বজলুর বিচার চেয়ে বিশেষ মোনাজাত ও দোয়া মাহফিলও অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে এলাকার মানুষকে নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা যায়। অবশ্য বজলু গ্রেপ্তার হওয়ার পর গত শনিবার থেকেই চলছে মিষ্টি বিতরণ।

 

 

তবে গতকাল দিনভর চনপাড়ার অলিগলিতে ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বজলুর গ্রেপ্তার-রিমান্ডের খবরে এলাকায় স্বস্তি ফিরলেও চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে।

 

 

কারণ বজলু না থাকলেও তার অনুসারীরা এখনো নানাভাবে এলাকার মানুষকে হুমকি দিচ্ছে। যারা এখন বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন বজলু জামিনে বেরিয়ে তাদের দেখে নেবেন বলেও হুমকি দিচ্ছে তার লোকজন।

 

 

চনপাড়ার বাসিন্দা ভ্যানচালক জাকির হোসেন বলেন, ডন বজলু গ্রেফতারের পর অনেক স্বস্তিতে আছি। এখন সব অপরাধমূলক কাজও বন্ধ রয়েছে। বজলু যেন আবার ফিরে এসে এই এলাকা ঘিরে অপরাধের রাজত্ব সাজাতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের কাছে আর্জি জানান জাকির।

 



তার কথা প্রতিধ্বনী শোনা গেল রেন্ট-এ-কার ব্যবসায়ী রবিন মিয়া এবং কাঠমিস্ত্রি লিটন হওলাদারের কণ্ঠেও। তারা বলেছেন, “বজলু গ্রেপ্তারের পর মাদক ব্যবসায়ীরা গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু বজলুর পরিবারের লোকজন চনপপাড়ার প্রতিবাদী মানুষজনকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে।”

 

 

তারা বলছে, “বজলু জামিনে বেরিয়ে প্রতিশোধ নেবে। এমন অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন রবিন-লিটনের মতো আরও অনেকে। প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের কাছে তাদের একটাই অনুরোধ, চনপাড়ার মানুষকে যেন তারা শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।”

 

 

স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছে না জানিয়ে এ ব্যাপারে বারবার কেন প্রশাসনের সহযোগিতা চাইছে চনপাড়ার মানুষ? এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা বলেন, “জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্রয় পেয়েই তো বজলু এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন।

 

 

তাদের অনুগ্রহের কারণেই বজলুর মতো চিহ্নিত সনন্ত্রাসী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, প্যানেল চেয়ারম্যান ও  উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা হতে পেরেছিল। এসব পরিচয়ের অপব্যবহার করে গত ১৪ বছর ধরে সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম নৃশংসতা চালানোর দুঃসাহস দেখিয়ে বজলু।

 

 

বজলুর প্রশয়দাতা হিসেবে বারবার আলোচনায় উঠে আসছে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নাম। চনপাড়ার বাসিন্দা বাবুর্চি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বজলুসহ তার সাংগপাঙ্গদের অপরাধের ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর কাছে একাধিকবার বিচার দিয়েও কাজ হয়নি। এতে করে ঐসব অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে সাধারণ মানুষকে অত্যাচার ও নির্যাতন করেছে।’

 

 

“স্থানীয় সংসদ সদস্যের হয়ে কাজ করতেন বলেই, বজলুকে কেউ কিছু বলতো না বলেও অভিযোগ করেছেন”, স্থানীয় বাসিন্দারা।

 

 

চনপাড়ার ৫ নং ওয়ার্ডের নিউ প্যান্ট হাউজের মালিক শাকিল মিয়া বলেন, ‘বর্তমানে মাদক ব্যবসা বন্ধ রয়েছে। যার ফলে আমরা অনেক শান্তিতে রয়েছি। তবে আবার আমাদের মাঝে আতঙ্ক রয়েছে।’

 

 

নুরু ব্যাপারী নামে আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা ভয়ে আতঙ্কে কিছু বলতে পারি না। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকদিনের তৎপরতায় আমরা অনেক ভালো আছি। আমাদের এভাবে শান্তিতে ও ভালো থাকতে দিন।’

 

 

“বজলুর কারণে এলাকায় যেমন শান্তিতে থাকতে পারেননি, তেমনি এলাকার বাইরেও নানা কথা শুনতে হয়, জানিয়ে পিকআপ চালক আব্দুল মালেক বলেন, “চনপাড়ার সবাইতো আর খারাপ না।

 

 

বজলুর শেল্টারে থাকা কিছু লোক অপরাধ করায় আমাদের বদনাম হচ্ছে। আর এসব অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানাই।” এন.এইচ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর