বুধবার   ১৫ মে ২০২৪   জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩১

গাছের শত্রু সরকারি সংস্থা

শরীফ উদ্দিন সবুজ

প্রকাশিত: ২৯ এপ্রিল ২০২৪  


নারায়ণগঞ্জে সম্প্রতি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য হাজার হাজার গাছ কাটা হয়েছে। কিন্তু নতুন করে গাছ লাগানো হয়নি। ফলে স্থানীয় ‘মাইক্রো ক্লাইমেট’ দিনে দিনে  ঢাকার মতো উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবেশ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগানো ও জলাশয় তৈরির কথা বলছেন তারা।

 


গাছ লাগাতে আগ্রহী বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি বলছেন, তারা গাছ লাগানোর জায়গা পাচ্ছেন না। তবে এ ক্ষেত্রে ‘আশার বাণী’ শুনিয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বলছে, তারা গাছ লাগানো ও রক্ষণাবেক্ষণে আগ্রহীদের খুঁজছে। কেউ এলে তারা গাছ লাগানোর জায়গার ব্যবস্থা করবে।

 


১৯৯৭ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোড উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের সময়ই ৮ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তার দু’পাশে লাগানো হয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এ ছাড়া রাস্তা তৈরির আগের বেশ কিছু পুরোনো বিশাল আকৃতির গাছও ছিল।

 


নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট আইনজীবী আওলাদ হোসেন বলেন, ১৯৯৭ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোড তৈরির পর লাগানো গাছগুলো দ্রুত বড় হয়ে রাস্তার ওপরে ছাতার মতো ঢেকে দিয়েছিল।

 

প্রথম লিঙ্ক রোড ডাবল লেন করার সময় একবার এ সড়কের পাশের গাছ কাটা হয়। ২০২১ সাল থেকে রাস্তাটি চার লেন করা শুরু করলে পুরো রাস্তার গাছ কেটে মরুভূমি বানানো হয়েছে। রাস্তার দু’পাশে গাছ লাগানোর জায়গাও রাখা হয়নি।

 


বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক তারেক বিন ইউসুফ বাবু বলেন, শুধু লিঙ্ক রোডের গাছ না, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আট লেন করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জ অংশেই অন্তত ৫ হাজার গাছ কাটা হয়েছে। মুক্তারপুর-সৈয়দপুর-মদনপুর সড়ক করতে গিয়েও হাজার হাজার গাছ কাটা হয়েছে।

 

 

কিন্তু সে গাছগুলোর জায়গায় নতুন করে গাছ লাগাতে তারা দেখেননি। অথচ সওজের গাছ লাগানোর জন্য আলাদা দপ্তর রয়েছে। সম্প্রতি সওজ বিভাগ লিঙ্ক রোডের রাস্তার আইল্যান্ডে কিছু গাছ লাগিয়েছে। কিন্তু এসব গাছের বেশির ভাগ ছোট আকারের সৌন্দর্য বৃদ্ধির গাছ। অথচ লাগানো দরকার ছিল বৃক্ষজাতীয় গাছ।

 

 

যাতে পাখিরা খাবার পায়, মানুষ ছায়া পায়, প্রচুর অক্সিজেন পায়, প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ে। তাহলে বৃষ্টিপাতও বাড়বে। রাস্তার পাশে সরকারি ছোট জলাশয়ও থাকা দরকার।

 


অন্যদিকে নগরীতে গাছ লাগানোর জায়গার সংকট রয়েছে বলে আক্ষেপ করেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। তিনি বলেন, ‘জায়গার অভাবে আমরা গাছ লাগতে পারছি না।’

 


এসব ব্যাপারে সওজ বিভাগের নারায়ণগঞ্জ জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, উল্লিখিত তিনটি সড়কের পাশেই তারা গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন।

 

 

কোনো সংগঠন বা ব্যক্তি গাছ লাগাতে ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে আগ্রহী হলে তাদের জায়গা দেখিয়ে দেবেন। সওজের অনেক জায়গা বেদখল হয়ে আছে। সেসব জায়গার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে গাছ লাগানো হবে বলেও জানান তিনি।

 


শুধু সওজ না, গাছ কাটার ক্ষেত্রে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও কম যায় না। বিআইডব্লিউটিএ সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের ৫ নম্বর ঘাট এলাকার নদীতীর ভরাট করে তাদের নতুন স্থাপনা ও গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান নির্মাণের জন্য শতাধিক গাছ কেটে ফেলেছে। এসব গাছের মধ্যে শতাধিক বছরের পুরোনো একটি বটগাছও ছিল।

 

 

‘শীতলক্ষ্যা পাড়ের গাছ রক্ষায় নারায়ণগঞ্জবাসী’ নামের সংগঠনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের সংস্কৃতিকর্মী ও বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা এর প্রতিবাদ জানান।

 

 

সংগঠনের সমন্বয়ক কবি আরিফ বুলবুল বলেন, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসারে শীতলক্ষ্যা নদীর নারায়ণগঞ্জ মহানগর অংশ প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হওয়ায় এখানকার গাছপালা কাটা কিংবা প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী যে কোনো কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ সে আইন লঙ্ঘন করে এখানে কাজ করছে। এটি দেখার যেন কেউ নেই।

 


বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জের পোর্ট অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তিনি এখানে অল্প কয়েকদিন হলো এসেছেন। তাই এখনই এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারছেন না। পরে জেনে এ ব্যাপারে জানাতে হবে।

 


রেলওয়ের জমির গাছ বিভিন্ন সময়ে কেটে ফেলা হয়েছে রেল কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই। এমন মন্তব্য করেন নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি রফিউর রাব্বি। তিনি বলেন, সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন এলাকার বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তারা বারবার এসব গাছ কাটতে বাধা দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

 


রেলওয়ের জমির গাছ কাটা বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ স্টেশন মাস্টার কামরুল ইসলাম বলেন, পিডব্লিউডিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, বেসরকারি ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জে রেলওয়ের গাছ কেটে ফেলে। তারা বাধা দিলেও শোনে না। বলে ওপর থেকে অর্ডার নিয়ে এসেছে। যদিও কোনো কাগজপত্র দেখায় না। এখানে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা থাকলে হয়তো বাধা দিতে পারতেন।

 


নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, রাসেল পার্ক এলাকায় সিটি করপোরেশন ১০ হাজারের বেশি দেশি গাছ লাগিয়েছে। ফলে এখানকার তাপমাত্রা শহরের যে অংশে গাছ নেই, সেখানকার চেয়ে ২-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। গাছ ও জলাশয় থাকলে যে কোনো এলাকার মাইক্রো ক্লাইমেট বা অণু জলবায়ু ভালো থাকে, না থাকলে বিপর্যয় হয়।

 

 

যে কারণে সারাদেশে তাপপ্রবাহ হলেও সিলেটে সবচেয়ে আগে বৃষ্টিপাত হয়েছে। মানুষ স্বস্তি পাচ্ছে। অন্যদিকে উল্টো পরিস্থিতি  ঢাকা অঞ্চলে। নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় মাইক্রো ক্লাইমেট দিনে দিনে  ঢাকার মতো উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শরীফ উদ্দিন সবুজ, সিনিয়র সাংবাদিক।     এন. হুসেইন রনী  /জেসি