সোমবার   ১৩ মে ২০২৪   বৈশাখ ৩০ ১৪৩১

কেমন দুর্ধর্ষ ছিল মাকসুদের বাবা রফিক রাজাকার

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল ২০২৪  

 

কুর্কীতি করেও বারবার পার পেয়ে যাওয়ায় স্বাধীনতার এতো বছর পরেও আবার বেপরোয়া বন্দরের কুখ্যাত রাজাকার রফিকের ছেলে মাকসুদ চেয়ারম্যান। টাকা ছিটিয়ে আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে গোটা বন্দরকেই কিনে নিতে চায় মাকসুদ।

 

তবে এতো কিছু করছে এতে মুক্তিযোদ্ধারা মুখ না খোলায় এবং প্রতিবাদ না করায় এতে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের বই ‘শান্তি কমিটি ১৯৭১’ রাজাকারের তালিকায় মাকসুদের বাবা রফিক, দাদা মাইনুদ্দিন, চাচা আব্দুল মালেক ও আরেক চাচা সামাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

 

রাজাকার রফিকের জীবদ্দশায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার দিন পর্যন্ত মাকসুদের বাবা রাজাকার রফিক, দুই চাচা ও দাদার হাতে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, যুদ্ধকালীন সময়ে অগ্নিসংযোগ করে ১২ জনকে হত্যা করা, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি রাজাকার রফিক গংদের অত্যাচারের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।

 

মাকসুদের বিধ্বংসী রূপ দেখে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম সেলিম ওসমানও চুপ থাকতে পারেননি।

 

উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র ছাড়ার পরপরই সেলিম ওসমান মাকসুদকে নিয়ে বলেছেন, ‘ইতিমধ্যে আমি একটি এলাকায় চেয়ারম্যান খোঁজা শুরু করেছি। তাকে নিয়ে কাজ করব। এখন দুইজন আমার অমতে নির্বাচন করার চিন্তা ভাবনা করছে। আমি বলিনা একজন তো নিজেই বলেন রাজাকার সন্তান। মাকসুদ প্রমাণ করেছে করে দিয়েছেন উনি রাজাকার। আমি কখনো এটাকে ধরি নাই। মানুষের জন্য কাজ কর। আগের পাপ বাপ দাদার পাপ ভুলে যাও। পাপে বাপেকেও ছাড়ে না।

 

মাকসুদ সাহেব আমি আজকে এতগুলো মানুষের সামনে আবারো বললাম আল্লাহর কাছে মাফ চান। এবং আবার ফিরে আসেন আমি আপনাকে কিছু বলব না। তবে মনে রাখবেন আমরা মুক্তিযোদ্ধা। যদি ভালোই ভালোই কথা শুনেন তো শুনবেন। না হলে মুগুর কিভাবে বানাতে হয় দেখবেন। মুগুরের মাধ্যমে কিন্তু আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে।

 

আমি বললাম কথা দিলাম আপনি আগামী কালকের মধ্যে উইথড্রো করেন। আপনার সঙ্গে ৪ জন চেয়ারম্যন যেভাবে আমার কথা শুনেছেন আমার সামনে বসেছে আপনি মাসুদ সাহেব আপনিও আসেন। আপনার এত টাকা কোথায় থেকে হল মাসুদ সাহেব। আপনি বাড়ি বাড়ি টাকা দেওয়া শুরু করেছেন। আমার কাছে আমার হিসাব পরে।

 

প্রায় ৩ কোটি টাকা ইতিমধ্যে আপনি খরচ করে ফেলেছেন। ঐদিন নাইরে নাতি খাবলাইয়া হাবলাইয়া খাতি। আপনি ভুলে যাবেন না বাংলার মানুষ আপনাদের ক্ষমা করবে না। যদি আপনি আপনার রাজাকার পরিচয়টা দেন। আপনি আমার সন্তান হিসেবে জানেন। মাথায় টুপিও দাড়ি লাগিয়ে বইলেন না আমি মানুষের উপকার করি। কেন এই রমজান মাসে মানুষকে আপনি বিভ্রান্ত করছেন।

 

আপনি মহিলাদের বলছেন আমাকে ভোট দিলে ৩০০ করে টাকা দিবেন। মহিলাদের ৩০০ টাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। আপনি কেন একটি মানুষকে খারাপ বানানোর চেষ্টা করছেন। আমি আপনাকে নিষেধ করলাম। আমার ভবিষ্যত প্রজন্ম আমার মৃত্যু হলো কিন্তু আপনাকে ছাড়বে না।

 

আপনি কেন বসলেন না আপনি কেন আলোচনা করলেন না। আপনি মনে করলেন আমার জন্য একটি গরম চাদর ও দুই প্যাকেট মিষ্টি ও আমার বউয়ের জন্য একটি শাড়ি দিয়ে আপনি উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে যাবেন। ঐদিন ভুলে যান।’

 

কেমন রাজাকার ছিলেন মাকসুদের বাবা রফিক রাজাকার দেশ স্বাধীনের ৩০ বছর পরেও কিন্তু এখনও আধিপত্য কমেনি বন্দর থানার ধামগড় এলাকার কুখ্যাত রাজাকার রফিক চেয়ারম্যানের। যিনি বর্তমান উপজেলা চেয়ামর‌্যান প্রার্থী রাজাকারপুত্র মুসাপুর ইউনিয়নের পদত্যাগকারী মাকসুদ হোসেন।

 

তার বাবা রফিক রাজাকারের বাহিনীর ভয়ে দেশ স্বাধীনের পরেও আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসংখ্য নৃশংস হত্যাকাণ্ডের হােতা এই রফিক রাজাকারের নেতৃত্বে তার সন্ত্রাসী ছেলে মাকসুদও ঘটিয়েছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড।

 

রাজাকারের ছেলে বলার অপরাধে কয়েক বছর আগে বন্দর থানার কুড়িপাড়া বাজারে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তিযােদ্ধা আলাউদ্দিনকে। ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অপহরণ- এমন কোন অপকর্ম নেই যা করা বাকি রাখেনি রাজকার রফিক চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী ছেলেরা। সন্ত্রাসী ছেলেদের নেতৃত্বে ছিলেন ঘৃণিত রফিক রাজাকার। তার ছেলেরা যা খুশি তা-ই করতো। ভয়ে টু শব্দ করে না মানুষ।

 

এখন মাকসুদ চেয়ারম্যানের ছেলে শুভও বাপ-দাদার একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্দর থানার ধামগড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিল মাকসুদের বাবা এমএ রফিক। সে হাত মিলায় পাকহানাদার বাহিনীর সাথে। স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়। মেতে ওঠে হত্যার উৎসবে।

 

এলাকাবাসী জানিয়েছে, ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১ একদিনেই তার নেতৃত্বে হত্যা করা হয় এলাকার ৪ নিরীহ লোককে। তার হাতে ঐদিন নৃশংসভাবে খুন হয় ধামগড় গ্রামের বাসিন্দা গিয়াসউদ্দিন, আমিন উদ্দিন, মতি মিয়া ও আঃ হামিদ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ঘৃণিত রাজাকারের বাহিনী আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ১৩টি গ্রাম।

 

১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ রাজাকার রফিকের বাহিনী গুলি করে হত্যা করে ধামগড় গ্রামের নূর ইসলাম, নয়ামাটি গ্রামের আবদুল হামিদ, ইদ্রিস আলী, লালখারবাগ গ্রামের ইদ্রিস আলী, কুটিরবন্দ গ্রামের আবুল হাশেম, মােছেরছড়া গ্রামের জলিল মিয়া ও হরিপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজকে।

 

পিস কমিটির চেয়ারম্যান রফিকের নেতৃত্বে ছালামত, খালেক, মিন্নত আলী, আবদুস সালাম, গোলাম মাওলা, আলী হোসেন প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার বাহিনী তাণ্ডব চালায় ধামগড় ইউনিয়নে। অনেক দিন পর্যন্ত ঘৃণিত রাজাকার বাহিনীর নৃশংসতার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে ছিলেন তারা। স্বাধীনতার পর ভোল পাল্টায় রাজাকার রফিক।

 

কিছুদিন আত্মগােপনের পর আবার ফিরে আসে এলাকায়, আবির্ভূত হয় স্বরূপে। গড়ে তােলে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। ছলে বলে কৌশলে নির্বাচিত হয় ধামগড় ইউপি চেয়ারম্যান। আবার অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ওই কুখ্যাত রাজাকার।

 

দেশ স্বাধীনের পর রাজাকার রফিকের সন্ত্রাসীরা কুঁড়িপাড়া বাজারে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে মুক্তিযােদ্ধা আলাউদ্দিনকে। আলাউদ্দিনের অপরাধ, তিনি রফিকের ছেলেকে বলেছিলেন- রাজাকারের ছেলে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে বন্দরে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ বন্দর কমান্ড মুক্তিযােদ্ধা আলাউদ্দিনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলন, মিছিল-মিটিং পর্যন্ত করে।

 

আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে রাজাকার রফিক ও তার সন্ত্রাসীরা। রাজাকার রফিক বিয়ে করেছে ৪টি। ৪ পক্ষে তার ছেলে রয়েছে ৮ জন। প্রায় সবাই চিহ্নিত সন্ত্রাসী। রাজাকার রফিকের দ্বিতীয় স্ত্রীর বড় ছেলে আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বন্দর থানায় হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অপহরণ, অবৈধ অস্ত্র রাখা প্রভৃতি অপরাধে ১০টির বেশি মামলা ছিল।

 

পুলিশের হাতেও বেশ কয়েকবারও গ্রেফতারও হয় এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। প্রতিবারই জামিনে বেরিয়ে এসে এলাকায় কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব। দ্বিতীয় স্ত্রীর তৃতীয় ছেলে মুর্শেদ ওরফে মুন্সীও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে বন্দর থানায়। চতুর্থ ছেলে মোয়াজ্জেম ওরফে কালুর বিরুদ্ধে রয়েছে ২ হত্যাসহ ৯টি মামলা।

 

এলাকাবাসী জানিয়েছে, রাজাকার রফিকের অন্যান্য ছেলেও সন্ত্রাসী। তাদের ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটায় এলাকার মানুষ। মানুষের জমিজমা দখল করে এখন অগাধ সম্পত্তির মালিক রাজাকার রফিক। স্থানীয় মিলকারখানায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। এসব মিলকারখানায় ঠিকাদারি, ব্যবসাবাণিজ্য সবকিছুই পরিচালিত হতো তার ইচ্ছায়। মাকসুদ চেয়ারম্যানও তার বাবার কুকীর্তির পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। এস.এ/জেসি 

এই বিভাগের আরো খবর