শনিবার   ১১ মে ২০২৪   বৈশাখ ২৭ ১৪৩১

ফাঁকফোকরে পার পাবেন পাপ্পা গাজী!

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল ২০২৪  

 

# উপজেলা নির্বাচনে সীমা লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত করেনি আওয়ামী লীগ

 

উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি-মন্ত্রীদের সন্তান-আত্মীয়-স্বজনরা অংশগ্রহণ নিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে শক্ত বাধা নিষেধ দেয়া হয়েছে তা নারায়ণগঞ্জে একমাত্র মানেননি রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক মন্ত্রী ও নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতিক) ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পা গাজী। তিনি দলীয় যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তা উপেক্ষা করেই রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র কিনেছেন।

 

পাপ্পা গাজী রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগে সহ-সভাপতি পদে আছেন। এছাড়া তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও একজন সম্মানিত পরিচালক। পাপ্পা গাজীর মা হাছিনা গাজী রূপগঞ্জের তারাবো পৌরসভার মেয়র হিসেবে দায়িত্বে আছেন। একই পরিবারের সকল সদস্য রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন পদে ও দায়িত্বে থাকায় পাপ্পা গাজীর উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণকে বাঁকা চোখে দেখা হচ্ছে।

 

তবে পাপ্পা গাজী গোলাম দস্তগীর গাজীর মতো একজন পরীক্ষিত আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান হয়েও কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এর পেছনের বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। যেখানে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে আওয়ামী লীগের শতাধিক মন্ত্রী-এমপির আত্মীয় স্বজনরা উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যে পাপ্পা গাজীও একজন।

 

সূত্র বলছে, দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচন ২১ মে, আর এই ধাপের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন পাপ্পা গাজী। প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর দেখা গেছে, ১৫০ টি উপজেলার মধ্যে অন্তত ৩৭ টিতে সরাসরি আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজনরা প্রার্থী হয়েছেন।

 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সেটি এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। এ ব্যাপারে চলতি মাসের ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্র।

 

তবে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক সময়ের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে ধারণা করা যায় যে, আওয়ামী লীগের যারা সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে স্বজনদেরকে প্রার্থী করেছেন তাদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে না। আইনের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বেরিয়ে যাবেন বলেও অনেকের ধারণা। কারণ আওয়ামী লীগ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই সিদ্ধান্তটির মধ্যে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে।

 

বিশেষ করে স্বজনদের প্রার্থী করা যাবে না- এই ঘোষণার পর কতগুলো শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন- যারা এখন উপজেলা চেয়ারম্যান আছেন, তারা প্রার্থী হতে পারবেন। যারা আওয়ামী লীগ বা অন্য কোন অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদে আছেন, তাদেরকে স্বজন হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না ইত্যাদি নানা ফাঁক আবিষ্কার হচ্ছে এবং এই ফাঁকগুলো দিয়ে শেষ পর্যন্ত যে সমস্ত মন্ত্রী-এমপিরা প্রার্থী দিয়েছেন, তারা বেরিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

আওয়ামী লীগের অনেকেই বলছেন যে, আওয়ামী লীগের যে সমস্ত স্বজনরা নিজ যোগ্যতায় দলের বিভিন্ন পদে আছেন, তাদেরকে স্বজন হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, এরা নিজের যোগ্যতায় দলের পদ নিয়েছে, নিজেরাই দলে নেতৃত্ব পেয়েছে। এখানে পরিবারের বা মন্ত্রী এমপিদের কোন ভূমিকা ছিল না। আর একারণেই হবে তারা যদি নিজ পরিচয়ে প্রার্থী হন তাহলে সেটাকে সংগঠন বিরোধী তৎপরতা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না।

 

অনেক নেতাই আবার আওয়ামী লীগের নোয়াখালীর এমপি মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর বক্তব্য টানছেন। একরাম যুক্তি দেখাচ্ছেন, সন্তান যদি সাবালক হয় তাহলে তার একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আছে। তার সাথে একই রকম মনোভাব ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান।

 

শাজাহান খানের ছেলে সেখানে সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আর এ কারণেই এ সমস্ত ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত কোন শাস্তির কোপানলে পড়বে কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলেছেন যে, স্বজনরা যখন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটিতে ছিল তখন তাদেরকে বাঁধা দেয়া হয়নি।

 

যিনি জনপ্রিয় তিনি প্রার্থী হবেন, তিনি স্বজন না দুর্জন সেটি বিবেচনার বিষয় নয়। এ সমস্ত নানা যুক্তির মারপ্যাচে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনকারীরা পার পেয়ে যাবে বলে অনেকে মনে করছেন। আর এই সুযোগে পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে গোলাম দস্তগীর পুত্র গোলাম মর্তুজা পাপ্পা গাজীরও।

 

তবে এই দুঃসাহস আওয়ামী লীগ অতি ক্ষমা প্রবণতা থেকেই পাচ্ছেন প্রার্থীরা। যদিও আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭(১১) ধারায় বলা আছে, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হলে সরাসরি বহিষ্কার হবেন। এমনকি প্রার্থী না হলেও কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করলে তদন্ত সাপেক্ষে বহিষ্কার হবেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে সেই সম্ভাবনা উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দলীয় নির্দেশনা না মানার বিষয়টি এবারই প্রথম নয়।

 

এর আগেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ একই ধরনের হুঁশিয়ারি দিলেও পরে নির্দেশনা উপেক্ষাকারী নেতাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে হয়। এমনকি তৃণমূলকে দলের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করতে আওয়ামী লীগ তাদের সনদে বহিষ্কারের বিধানও সংশোধন করেছে। কিন্তু আশানুরূপ ফল মেলেনি। আসন্ন উপজেলা নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে কেন্দ্রীয় নেতাদের। সাংগঠনিক নির্দেশনা উপেক্ষার কারণ সন্ধান করছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।

 

মূল কারণ হিসেবে তারা মনে করছেন, অতীতে একাধিকবার বহিষ্কারের কথা জানিয়ে পরে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। বারবার একই পদক্ষেপ নেয়ায় দলীয় নেতাকর্মীরা বিষয়টিকে হালকা হিসেবে নিয়েছেন। তাদের ধারণা, দল নির্বাচনের জন্য কৌশলগত অবস্থান ধরে রাখতে বহিষ্কারের হুমকি দেয়, সাংগঠনিক নির্দেশনা জারি করে। পরে ঠিকই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে।

 

এর আগে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচন বা বিদ্রোহী প্রার্থীকে সহায়তা করেছিলেন তাদের বহিষ্কার বা শাস্তি নিয়ে স্বস্তির বার্তা দিয়েছিল দলটি। ২০১৯ সালের ২১শে অক্টোবর বিদ্রোহী নেতাদের কাছে পাঠানো হয় চিঠি।

 

তাতে বলা হয়, ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থি কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে তাদের ক্ষমা করা হয়েছে। তবে, ১৯২ জন সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডের কথা স্বীকার করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি দেন। তারা ভবিষ্যতে সংগঠনের গঠনতন্ত্র, নীতি ও আদর্শ পরিপন্থি কোনো কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না হওয়ারও অঙ্গীকার করেন।

 

১৯২ জনের মধ্যে উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহীদের মধ্যে ১২৬ জন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এই চেয়ারম্যানরাসহ ওই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার শঙ্কা ছিল বেশ জোরালো। দ্বিতীয় ধাপে দলের শতাধিক নেতাকর্মীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ।

 

২০২২ সালের ১৭ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে দলের জাতীয় কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

 

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রায় শতাধিক আবেদন জাতীয় কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় কমিটি বরাবর সর্বসম্মতিক্রমে যারা আবেদন করেছিল তাদের দলের সভাপতি ক্ষমা করে দিয়েছেন। অন্য যারা আছে তারা যদি দলের সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে সভাপতির কাছে আবেদন করে, তাহলে জাতীয় কমিটি আমাদের এই ক্ষমতা দিয়েছে যে, তিনি (শেখ হাসিনা) আবেদন গ্রহণ করে ক্ষমা করে দিতে পারবেন।

 

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কার্যনির্বাহী সংসদ কর্তৃক গৃহীত শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপিল বিবেচনা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতা দেয়া আছে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটিকে। সেই কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া বিদ্রোহীদের ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত আসে।

 

আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের বৈঠকে দলের বহিষ্কৃতদের সাধারণ ক্ষমা করার সিদ্ধান্তের পরপরই প্রায় কয়েকশ’ আবেদনের ফাইল জমা পড়ে আওয়ামী লীগের দপ্তরে। দলীয় নেতারা জানান, মূলত একের পর এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় দলীয় নির্দেশ অমান্যকারী নেতাদের লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না। এস.এ/জেসি 

এই বিভাগের আরো খবর