শনিবার   ০৪ মে ২০২৪   বৈশাখ ২১ ১৪৩১

রূপগঞ্জে দেদারসে চলছে শতাধিক অবৈধ ইটভাটা” অবাধে পুড়ছে কাঠ

রূপগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২৪  


পরিবেশ দুষণ রোধে অবৈধ ইটভাটা নিয়ন্ত্রনে সরকারের ১০০ দিনের জিরো টলারেন্স কর্মসুচি চলমান থাকলেও  নারায়ণগঞ্জে  রূপগঞ্জের  পৌর শহরসহ ব্যঙের ছাতার মতো গড়েওঠা ইটভাটা গুলো দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবেশ পোড়ার কর্মযজ্ঞ। রূপগঞ্জ উপজেলায়  শতাধিক অবৈধ ইটভাটার সাথে পাল্লাদিয়ে পৌর শহরের প্রানকেন্দ্রে হাফ ডজন ভাটা বীরদর্পে তাদের অবৈধ  কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

 

 

এ গ্রেডের জনপদ তারাব পৌরসভার  প্রাণকেন্দ্রে আবাসিক এলাকার জনাকীর্ণ, লোকালয়ে  এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নীকটবর্তি স্থানে গড়ে ওঠা  ৬টি ভাটা এখন বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।

 


উপজেলার  জনবসতিপুর্ন লোকালয়ে  গড়েওঠা  এসব  ইট ভাটা গুলোতে  মানা হচ্ছেনা কোনও  সরকারি নীতিমালা। প্রকাশ্যে দিবালোকে  সরকারি নিয়ম-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে  অবাধে বীরদর্পে  পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। রূপগঞ্জের  অন্যান্য এলাকার মতো অবাধে গড়েওঠা বেশ কয়েকটি ইটভাটা  উন্নত নাগড়িক  সুযোগ সুবিধা সম্বলিত প্রথম সারির  পৌর শহরের আবাসিক এলাকার পরিবেশের জন্য  মারাতক  হুমকির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।

 

 

একদিকে কৃষি জমির টপ সয়েল এসমস্থ ভাটার একমাত্র  কাঁচামাল হিসেবে অবাধে ব্যবহার হওয়ায় হৃাস পাচ্ছে ফসলি জমি। যার ফলে একদিকে হাজার হাজার একর জমি পতিত হয়ে কৃষি বিধ্বস্ত হচ্ছে, অপরদিকে ধুলা-বালি আর ধোঁয়ায় পরিবেশ এবং জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।

 


রাজধানী ঢাকার পর দূষণের তালিকায় রয়েছে নারায়ণগঞ্জের নাম। আর এর অন্যতম কারণ ইটভাটা। পরিবেশবিদদের মতে বায়ু দূষণের জন্য ৫৮ ভাগ দায়ী ইটভাটা। সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। ভাটার কালো ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ। ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।

 


খোঁজ নিয়ে জানাযায়, সরকার কতৃক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় অবৈধ ইটভাটা বন্ধে এবং ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার বন্ধ ও পরিবেশ দূষণরোধে ১০০ দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকা ও তার আশপাশে  অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে অভিযান  চালিয়ে অনেক ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।

 

 

চলমান এ কর্মসুচি মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে সরকারের অবৈধ ইটভাটা বন্ধে চলমান অভিযানেও উপজেলার অবৈধ ভাটা গুলো কিভাবে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বীরদর্পে চলছে এ নিয়ে জনমনে প্রশ্নের সঞ্চার হয়েছে।

 


ইট ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী , জালানী হিসাবে কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ ও বিশেষ কোনো স্থাপনা, রেলপথ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং লোকালয়ের  তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ইটভাটা নির্মাণে  বিধি-নিশেধ থাকলেও  তা আমলেই নিচ্ছেন না এখানকার  ইটভাটা মালিকেরা।

 

 

বিগত দিনে অন্যান্য  এলাকার ইট ভাটায় অভিযান পরিচালনা হলেও রহস্য জনক কারণে তারাব পৌর শহরের এসব  ইটভাটায় কোনো অভিযান পরিচালনা হয় না। বারবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে এই ৬টি ইটভাটা।  ফলে বীরদর্পে অবৈধ ভাবে উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ভাটাগুলো। এতে বিনষ্ঠ হচ্ছে পরিবেশ ধংশ হচ্ছে কৃষি জমি জনস্বাস্থও রয়েছে হুমকিতে।

 


নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, রূপগঞ্জে মোট অবৈধ ইটভাটা রয়েছে ১১৪টি। জেলায় সবচেয়ে বেশি ইটভাটা রয়েছে রূপগঞ্জ  উপজেলায়। ছাড়পত্র ও নবায়ন ছাড়া নারায়ণগঞ্জে পরিচালিত জিগজ্যাগ পদ্ধতির ইটভাটা রয়েছে ১৫১টি। এর মধ্যে রূপগঞ্জেই  রয়েছে ৮২টি। আর ১২০ ফুট চিমনিবিশিষ্ট অবৈধ ইটভাটা রয়েছে ১০৭টি।

 

 

এর মধ্যে রূপগঞ্জ উপজেলায়  রয়েছে ৩২টি। উপজেলায় তারাব পৌর এলাকার পাশাপাশি  দাউদপুর ইউনিয়নেও রয়েছে ব্যঙ্গের ছাতার মতো ইটভাটা। এক সময়ের কৃষি নির্ভর সুজলা সুফলা দাউদপুর ও পুরছে  অবৈধ ইট ভাটার কয়লার গ্রাসে। দাউদপুর ইউনিয়নেই রয়েছে প্রায় ৬৪ টি ইটভাটা।

 


সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, তারাব পৌর শহরের ৩নং ওয়ার্ডের কর্নগোপে রয়েছে ৩টি,মাসাবতে রয়েছে ২টি, এবং কান্দাপাড়ায় ১টি সহ ৬টি ইটভাটা  জনবহুল আবাসিক এলাকায় তাদের  অবৈধ উৎপাদন কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে  দাউদপুরের  শিমুলিয়া , বেলদী,দেবই,খৈসাইর,খাস দাউদপুর, খাস কামাল কাটিসহ  শীতলক্ষ্যার দুপারের  রয়েছে সারিসারি  ইটভাটা।

 

 

এসব ইট ভাটায়  প্রকাশ্যে পুড়ানো হচ্ছে কাঠ। কয়লার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সহজ জ্বালানী হিসেবে কাঠ ব্যবহার হচ্ছে হরদম। ফসলি জমি ও নদী তীরের বসতি ঘরের পাশেই গড়া এসব ইটভাটায়  নানা অনিয়মের  মাধ্যমে চালাচ্ছে তাদের  উৎপাদন  কার্য্যক্রম।

 


জ্বালানি হিসেবে  কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও এ আইন মানা হচ্ছে না সেখানে। ভাটার সামনে হাজার হাজার মণ গাছের খড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন মহল্লা ও বাজারের মধ্য দিয়ে মাটি টানা ট্রাক, ট্রাক্টর মাটি, খড়ি, ইট বোঝাই করে ট্রাকের পর ট্রাক যাতায়াত করছে ইটভাটায়। ধুলাবালিতে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে নষ্ট হচ্ছে রাস্তা-ঘাট। অন্যদিকে  কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে নিয়ে চলে আসছে ভাটায়। হাস পাচ্ছে কৃষি জমি।

 


তারাব পৌর শহরের অন্যতম জনবহুল এলাকা কর্নগোপে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভাটা । এর মধ্যে মুন্নি ব্রিকস নামক একটি ইটভাটা জনবহুল  আবাসিক এলাকার একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,একাটি মাদ্রাসা ও ইউএস বাংলা ছাত্র ও ছাত্রী হোস্টেলের সংলগ্ন হওয়াতে এ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ন্ত্রীত কর্মকান্ডে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সহ এ এলাকায় বাসিন্দারা সব চাইতে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।

 

 

অন্যদিকে অত্র এলাকায় প্রবেশের একমাত্র পথ কর্নগোপ -গন্ধর্বপুর সড়কের ফুটপাত দখল করে উৎপাদিত ইট স্তুপদিয়ে রাখার কারণে  পথচারী চলাচলে ভোগান্তীর পাশাপাশি দুর্ঘটনার আশঙ্কা  তৈরী হয়েছে। অপরদিকে ইট ভাটাগুলোর চিমনি পরিবেশ অধিদপ্তরের  নিয়ম না মেনে স্থাপন করায় কালো ধোয়া প্রবেশ করে এলাকার বসত ঘরে। এতে করে ভাটা পার্শবর্তি এলাকার  শিশু ও বৃদ্ধ শ্রেণির মানুষ নানা বায়ু বাহিত রোগে ভুগে থাকেন।

 


মুন্নি ব্রিকস  ইটভাটা সংলগ্ন পৌর এলাকার কর্ণগোপ এলাকার  বাসিন্দা মোঃ সিফাতুল  বলেন, পৌরসভার মধ্যে অবৈধভাবে ৬টি  ইটভাটা চলছে নির্বিগ্নে। এর মধ্যে মুন্নি ব্রিকস  ইটভাটার অবস্থান জনাকীর্ণ আবাসিক এলাকায় স্কুল, মাদ্রাসার অতি নীকট বর্তী হওয়ার কারণে  শিক্ষার্থীরাসহ এলাকার মানুষ ধুলা-বালি আর ধোয়ায় বিপন্ন পরিবেশ ও রাস্তায় চলাচলে ভোগান্তি পোহাচ্ছে।

 


পৌর শহরের মাসাব এলাকার বাসিন্দা বাহারউদ্দিন বলেন, প্রথম সারির তারাব পৌরসভার প্রানকেন্দ  অবাসিক এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংলগ্ন এক ওয়ারর্ডেই  রয়েছে ছয়টি ইটভাটা। সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই সেখানে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।  গাছপালা ও পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

 


বেলদি এলাকার মহিউদ্দি  নামের এক কৃষক বলেন, কৃষি জমির উপরের  অংশের মাটি  প্রতিদিন শত শত ট্রাক বোঝাই করে  ইটভাটায যাচ্ছে। এ কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে।‘বছরের পর বছর এসব ভাটা ধারা নির্বিগ্নে পরিবেশ দুষন করলেও দেখার যেন কেউ নেই।

 


 ইটভাটার পোড়াই মিস্ত্রী আবুল বাসার জানান, প্রতিদিন একেকটি ভাটায় কয়লার সাথে  ৪৫০ থেকে ৫০০ মণ কাঠের লাখড়ি  পুড়তে হয়। কয়লার মুল্য বৃদ্ধির কারণে মালিক পক্ষ্য ইট পোড়াতে কাঠের দিকেই ঝুঁকছে। কতৃপক্ষ আমাদের  কাঠ বা কয়লা যখন যা দিচ্ছে তা দিয়েই আমরা পোড়াই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

 


মুন্নি ব্রিকসের ম্যানেজার  রিপন বিশ্বাস বলেন,  বর্তমানে বাজারে  কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেশি পরে। অন্যদিকে কাঠের লাখড়ি দিয়ে ইট পোড়ালে তুলনামুলক  ব্যয় অনেক কমে যায় । ফলে লাভ একটু বেশি পাওয়া যায়। কয়লার দামটা কমার সঙ্গে সঙ্গে ভাটায় খড়ি ব্যবহার বন্ধ করে আমরা কয়লা ব্যবহার করবো।

 


নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, পৌরসভার মধ্যে এভাবে ইটভাটা পরিচালনা করার কোনো বৈধতা নেই। তবে এসমস্থ  ইটভাটার  বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে  মামলা বিচারাধীন থাকার কারণে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে আমরা কিছুই করতে পারছিনা। অন্যান্য অবৈধ সকল ইটভাটার বিরুদ্ধে আমরা অচিরেই আইনগত ব্যবস্থা নেব।

 


রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, আমি এ উপজেলায়  কিছুদিন হয় যোগদান করেছি । এ সকল এলাকা পরিদর্শন করে অবৈধ ইটভাটা গুলোর অপতৎপরতা বন্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করিব। নিয়মের বাইরে কোনো ইটভাটা চলতে দেওয়া যাবে না। আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।    এন. হুসেইন রনী  /জেসি

এই বিভাগের আরো খবর