শনিবার   ০৪ মে ২০২৪   বৈশাখ ২১ ১৪৩১

এমপির সন্তান হুইপের আত্মীয়রাই ফ্যাক্টর

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২০ এপ্রিল ২০২৪  

 

অদৃশ্য ইশারায় নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ২২ এপ্রিলের পর পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে, আগামী ৮ মে বন্দর উপজেলার সাথে সদর উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে কি না? বন্দর উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সরগরম পরিস্থিতির মধ্যেই দ্বিতীয় ধাপে আগামী ২১ মে অনুষ্ঠিতব্য রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাচন পরিস্থিতিও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

 

সদর ও বন্দরে এমপির সন্তান ও আত্মীয়রা তেমন সরব না হলেও রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারে নির্বাচনে এমপির সন্তান ও আত্মীয়রাই ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী না থাকলেও মন্ত্রী-এমপিদের এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মাঠে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাদের ভোটের মাঠে না থাকাতে দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা না থাকলেও মাঠ পর্যায়ে সেটা মানা হচ্ছে না।

 

বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের এমপি, সাবেক মন্ত্রী ও রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতিক) এর ছেলে গাজী গোলাম মর্তুজা পাপ্পা রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে প্রস্তুতি আছে বলে জানা গেছে। তিনি জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সহ-সভাপতি। পাপ্পা গাজী রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদেও রয়েছেন। এছাড়া গোলাম দস্তগীর গাজীর স্ত্রী হাসিনা গাজী তারাবো পৌরসভার মেয়র।

 

একই পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ সব দলীয় ও জনপ্রতিনিধির পদ দখল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তৃণমূলে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগের কড়া নির্দেশনা থাকার পরও এবার রূপগঞ্জে পাপ্পা গাজী নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে ধারণা স্থানীয়দের। কেননা, রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া এমপি গাজীর সাথে সখ্যতা থাকার সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ পান।

 

যদিও সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গাজী বিরোধী হিসেবে তিনি সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেছেন। এবার ইস্তফা দেওয়া পদে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদেও তিনি লড়বেন বলে জানা গেছে। আর তাকে ঠেকাতেই আগে থেকেই এমপি গাজীর পুত্র পাপ্পা গাজী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করবেন। এটি নিয়ে রূপগঞ্জে সংঘাত ও সংঘর্ষের আশঙ্কাও বেড়েছে। 

 

যদিও নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে আসন্ন এই নির্বাচনে প্রার্থীতার বিষয়টি উন্মুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় আয়ামী লীগ। এছাড়া দলের মধ্যে গ্রুপিং এবং সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে এবার কাউকে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কেন্দ্রীয় এই সিদ্ধান্ত মেনে চলতে দলীয় নেতা ও এমপিদের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার বা পরিবারের সদস্যদের প্রার্থী করা যাবে না। কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করলে সংশ্লিষ্ট এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

কিন্তু কেন্দ্রের এই নির্দেশনার পরেও অনেকেই হাঁটছেন উল্টোপথে। তাদের মধ্যে অনেকে প্রকাশ্যে আবার কেউ কেউ গোপনে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কর্মীদের মধ্যে অনেকে অন্তরালে ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন। এই পরিস্থিতি রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজারে এমপি ও হুইপের সন্তান ও আত্মীয় স্বজনদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে পারে। কেন্দ্র যতোই বিশৃঙ্খলা এড়াতে চাচ্ছে কিন্তু এসব পরিস্থিতে বিশৃঙ্খলা হবেই বলে আশঙ্কা তৃণমূলের। 

 

আড়াইহাজারের বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান হেলো সরকার। সর্বশেষ এক ফোন কল বিতর্কে তিনি সমালোচিত হন। ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে অনেক সহজে পার পেলেও এবার তা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনের এমপি নজরুল ইসলাম বাবু এবার জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার জাতীয় সংসদের হুইপ নির্বাচিত হয়েছে।

 

নজরুল ইসলামা বাবুর ভাগ্নে ইকবাল হোসেন মোল্লা সর্বশেষ ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। এবার উপজেলা নির্বাচনে হুইপ বাবুর ভাগ্নে ইকবাল হোসেন মোল্লা নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাচনে এমপি ও হুইপ নজরুল ইসলাম বাবুর ভগ্নিপতি ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান আবু তালেব মোল্লাও নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে জানিয়েছে সূত্র।

 

উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ যাতে পরিবারের বাইরে কেউ দখলে না নিতে পারে সেজন্য নজরুল ইসলাম বাবুর ভাই দুপ্তারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল হাসানও নির্বাচন করতে আগ্রহী। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে দেশের উল্লেখযোগ্য আসনে বর্তমান এমপিদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যানরাই। আগামী নির্বাচনেও একই পরিস্থিতি তৈরি হলে ঝুঁকি কমাতেই এমন কৌশল এমপিদের।

রূপগঞ্জ উপজেলাতেও তৎকালীন মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভুঁইয়া। আড়াইহাজারের এমপি নজরুল ইসলাম বাবু হুইপ হওয়া সত্ত্বেও সেদিকে হাঁটতে পারেন। কেননা, তিনিও গোলাম দস্তগীর গাজীর মতোই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদটি দখল নিয়েছেন।

 

যদিও তার অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম সরকার উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হবেন এমন কথাও চাউর রয়েছে। তবে আড়াইহাজারে নজরুল ইসলাম বাবুর কাছে উপজেলা আওয়ামী লীগের পদ হারান এই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজালাল মিয়া। তিনি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যানও ছিলেন। এবার এখানে উপজেলা নির্বাচনে বর্তমান হেলো সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমলেও সাবেক চেয়ারম্যান শাহজালাল মিয়াকেই শক্ত প্রার্থী হিসেবে ধরা হচ্ছে।

 

যদিও তাকে ঠেকাতেই এমপি ও হুইপের পরিবারের বেশ কয়েকজন প্রার্থী হবেন বলে সূত্র জানিয়েছে। নির্বাচনী পরিবেশ বিনষ্টের মতো অভিযোগ কারো বিরুদ্ধে পাওয়া গেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। তবে এটি শেষ পর্যন্ত টিকবে কিনা সেটিও প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অধিকাংশ নেতার অভিমত ছিল প্রতীক বরাদ্দের কারণে দলের তৃণমূলে গ্রুপিং বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে উপজেলা নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দ বাদ দেয়া হয়েছে।

 

এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারও উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। কিন্তু এখন মূল সমস্যা হয়েছে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সদস্য, এমপি, মন্ত্রী ও হুইপরা তাদের এলাকার আত্মীয়স্বজন, সন্তানদের প্রার্থী করছেন। এ কারণে দলের অনেক জায়গায় চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমপি-মন্ত্রী-হুইপদের প্রশাসনের উপর খবরদারি করার সুযোগ আছে-এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন এমপি-মন্ত্রীদের পরিবারের সদস্যরা নির্বাচন করতে পারবেন না।

 

যদিও এসব নির্দেশনা আদৌ রূপগঞ্জ আড়াইহাজারে কার্যকর হবে কিনা এ নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। এদিকে দলের নেতা ও এমপি মন্ত্রীদের এমন অবস্থা বন্ধে দলকে বেশ বেগ পেতে হবে বলেও মনে করেন তৃণমূলের কেউ কেউ। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য প্রার্থী হওয়া এবং সমর্থনের বিষয় নিয়ে কেন্দ্র থেকে একটা গাইডলাইন দেওয়া হলে সকলের জন্য সুবিধা হবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। উন্মুক্ত বলে এভাবে দলকে ছেড়ে দেওয়া হলে সবাই নির্বাচনের জন্য দাঁড়িয়ে যাবে।

 

প্রতি জায়গায় যদি ১০/১২ জন করে প্রার্থী হয়ে যায়, তাহলে দলীয় শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে। আর দায়িত্বশীল নেতা, এমপি, মন্ত্রী, হুইপদের নির্দেশ দিয়ে বিরত রাখাও কঠিন হবে? তথ্যপ্রযুক্তির যুগে নানাভাবে সমর্থন দেয়া যায়। এগুলো মনিটরিং করাও কঠিন এজন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত একটা গাইডলাইন থাকলে সবার জন্য সুবিধা হবে। তা না হলে দলে বিশৃঙ্খলা ও বিভক্তি বৃদ্ধি পাবে। এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর