শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ডিএনডি প্রজেক্টে নেই বৃহত্তর লালপুর ও ইসদাইর

তুষার আহমেদ

প্রকাশিত: ১ জুন ২০২১  

ডিএনডি বাঁধ অধ্যুষিত ফতুল্লার বৃহত্তম এলাকা লালপুর ও ইসদাইর। এসব এলাকার অভ্যান্তরিন সড়কগুলো বছরের বেশির ভাগ সময়ই থাকে পানির নিচে। আর বর্ষা মৌসুমে এই চিত্র হয়ে উঠে আরো ভয়াবহ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান দৌড়ঝাপ করে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য ডিএনডির মেগা প্রকল্প বাগিয়ে আনেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যা বাস্তবায়নে কাজ করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তাই ডিএনডির মেগা প্রকল্পের খবরে অন্যান্য পানিবন্দি এলাকার মানুষদের মতই উচ্ছাসের কমতি ছিলো না বছরের পর বছর জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত থাকা বৃহত্তর লালপুর ও আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের। শামীম ওসমানের প্রসংশাতো বটেই, খুশির আমেজে মিষ্টি বিতরণের খবরও পাওয়া গিয়েছিলো ফতুল্লার লালপুর থেকে।

 


তবে, সেই উচ্ছাস এখন আক্ষেপে পরিণত হয়েছে। কারণ, বৃহত্তর লালপুর ও ইসদাইর এলাকাটি ডিএনডি অধ্যুষিত হলেও ডিএনডির মেগা প্রকল্পের আওতায় ওই দুই এলাকার নাম নেই। তাই সাংসদ শামীম ওসমানের বদান্যতায় জলাবদ্ধতামুক্ত এলাকার যেই স্বপ্ন দেখেছিলো বৃহত্তর লালপুর ও ইসদাইর এলাকার লাখো মানুষ, সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। ডিএনডি প্রজেক্টের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘ডিএনডির মেগা প্রকল্পের নকশায় বৃহত্তর লালপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা অর্ন্তভূক্ত নয়। কারণ নকশা প্রস্তুতকারক সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব এলাকা ডিএনডি প্রজেক্টের নকশায় অর্ন্তভূক্ত করেনি।’

 


এদিকে, লালপুর এলাকাটি ডিএনডি প্রজেক্টের আওতাভুক্ত না করায় স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে কোন কাজ ধরা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় ফতুল্লার ডিআইটি মাঠ সংলগ্ন খালের অভিমুখে একটি সুইচ গেইট নির্মান করলেও লালপুরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া দখল-দূষণে পড়া খালটি পূনরুদ্ধার করা হয়নি। অথচ, স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই খালটি উদ্ধার করা গেলে এবং রেললাইন বটতলা এলাকাস্থ জনি ডাইংয়ের অভিমুখে থাকা আরো একটি খালের পানি প্রবাহিত করা গেলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলতো লালপুর সহ আশপাশের এলাকা।

 


এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ড কেন লালপুর, ইসদাইর গাবতলী ও টাগারপাড় এলাকা ডিএনডি প্রজেক্টের অর্ন্তভুক্ত করেনি, সেই বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। বর্তমান কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। তবে, দপ্তরটির সাবেক উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী সামসুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি রিটায়ার্ড করেছি। তবে, নকশায় ডিএনডি অধ্যুষিত সকল এলাকা উঠে আসার কথা। ১৯৬০ সনের নকশা প্রস্তুত করে আমি তা পরবর্তী কর্মকর্তার কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি। হয়তো ডিএনডির উন্নয়ন প্রজেক্টের নকশার ক্ষেত্রে লালপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোকে আপাতত বাদ রাখা হয়েছে। তারপরও বর্তমান কর্মকর্তা এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারবেন।’

 


পূর্ব লালপুর এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল শেখ সহ অন্যান্য বাসিন্দারা বলছেন, ফতুল্লার মধ্যে অন্যতম নিম্নাঞ্চল হলো লালপুর, ইসদাইর ও টাগারপাড় এলাকা। খাল দখলসহ নানা কারণে এখানে জলাবদ্ধতা লেগেই থাকে। সাংসদ শামীম ওসমানের বদান্যতায় ডিএনডি প্রজেক্ট আসার পর ভাবা হয়েছিলো, প্রজেক্ট সম্পন্ন হলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু প্রজেক্টের উন্নয়ন কাজের নকশায় লালপুরসহ আশপাশের নিম্নাঞ্চল ডিএনডি প্রজেক্টের আওতায় না পড়ায় শতকোটি টাকার এই মেগা প্রকল্পের সুফল ভোগ থেকে বঞ্চিত হতে হবে এই এলাকার বাসিন্দাদের। এর ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারের বরাদ্ধকৃত ১২৯০ কোটি টাকা বিফলে যাবে বলেও মনে করছেন তারা। এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ শামীম ওসমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তাই তার পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। তবে, দ্রুত সময়ের মধ্যেই এই বিষয়ে শামীম ওসমানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৬৫ থেকে ৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকার ডেমরা, কদমতলী, যাত্রাবাড়ি, শ্যামপুর, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জের ৫৮ দশমিক ৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে বাধ নির্মিত হয়। যা ডিএনডি বাধ নামে পরিচিত। ডিএনডি’র ৩০ লাখ বাসিন্দার দুই যুগের কৃত্রিম জলাবদ্ধতা আর অবর্ণনীয় দুর্ভোগের স্থায়ী সমাধান করতে সরকার ডিএনডি প্রজেক্ট নামে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট একনেকের সভায় প্রথমে ৫৫৮ কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্প পাস হওয়ার খবরে সিদ্ধিরগঞ্জ, ফতুল্লা, ঢাকার ডেমরাসহ আশপাশের এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের উপস্থিতিতে বিশাল জনসভায় এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়। একই বছরের ২ সেপ্টেম্বর এই প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সেনাবাহিনী চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনস্থ ১৯ ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন ব্যাটালিয়ন। ২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ জুন ২০২৩ করা হয়। মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি এ প্রকল্প উন্নয়নে নতুন করে ৭৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
জলাবদ্ধতা দূর করণে মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও শেষ পর্যন্ত জলাবদ্ধতার মধ্যেই উপনিত থাকছে ফতুল্লার বৃহত্তর লালপুর এলাকাটি।

 

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লালপুরের জলাবদ্ধতা নিস্কাশনের জন্য পূর্ব লালপুর বাংলাদেশ খাদ এলাকায় আলাদা করে পাম্প হাউজ বসানো হয়েছে। সেখানে ৫০ ও ২৫ ঘোড়া ক্ষমতা সম্পন্ন ৩ টি পাম্প রয়েছে। বৃহত্তর লালপুর, ইসদাইর, টাগারপাড়, গাবতলী, বাংলাদেশ খাদ ও আশপাশের বিস্তীর্ন এলাকার নানাবিধ পানি এসব পাম্প দিয়ে নিরসন করা যাচ্ছে না। ফলে বৃষ্টি হলে পানিতো থাকছেই, অনেক ক্ষেত্রে শুস্ক মৌসুমেও ডাইং কারখানা ও গৃহস্থালির পানি সরছে না।

 


অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ওই পাম্প হাউজের বৈদ্যুতিক বিল ৬২ লাখ টাকা বকেয়া জমেছে। ইতিপূর্বে বকেয়া বিলের জন্য ৪ বার বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দিয়েছিলো ডিপিডিসি। মাত্র তিন থেকে চার বছরের মধ্যে এই বিপুল পরিমান বিদ্যুৎ বিল জমা পড়ায় তা নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছে অনেকে। ৩টি পাম্পের জন্য ২টি বৈদ্যুতিক মিটার স্থাপন করা হয়েছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান খন্দকার লুৎফুর রহমান স্বপনের নামে। মাসে মাসে তার নামেই আসে বিদ্যুৎ বিল। এখনো পর্যন্ত ৪ লাখ টাকার বিল দিয়েছেন তিনি। তাও আবার সড়ক সংস্কারের একটি প্রকল্প থেকে আসা কাজের অর্থ থেকে ওই ৪ লাখ টাকা দেয়া হয়। এরপরও গত এপ্রিল পর্যন্ত বকেয়া পড়ে আছে ৬২ লাখ টাকা।
 

এই বিভাগের আরো খবর