শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘দুর্নীতি বাংলাদেশের সর্বত্র ক্যান্সারের মতো বিস্তার লাভ করেছে’

আহমদ তমিজ

প্রকাশিত: ২৬ মার্চ ২০২৪  


বলা হয়ে থাকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে আধুনিক বিচার ব্যবস্থা সর্বপ্রথম প্রাচীন গ্রীসে উদ্ভব হয়েছিল। সেই সময় গ্রিক দার্শনিক পন্ডিত সক্রেটিস বলেছিলেন, বিচারকদের মানদন্ড হিসেবে সঠিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চারটি জিনিস বিচারকদের নিজস্ থাকতে হবে।

 

 

তা হচ্ছে বিনয় সহকারে শোনা, জ্ঞানীর মত উত্তর দেয়া, সংযত হয়ে বিবেচনা করা, এবং বিচারের ক্ষেত্রে পক্ষ পাতিত্ব না করা। সক্রেটিসের এ বক্তব্য বাংলাদেশের আইন আদালত ও বিচারের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করলে আমাদেরকে হতাশাই প্রকাশ করতে হয়।

 


গত ১০ সেপ্টেম্বর ২৩ দেশে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আক্ষেপ করে বলেছেন দুর্নীতি বাংলাদেশের সর্বত্র ক্যান্সারের মতো বিস্তার লাভ করেছে। আর বিচার বিভাগও দুর্নীতিমুক্ত নয়। ফলে বিচার বিভাগের উপর বিচার প্রার্থীদের আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

 

 

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের বর্তমান আইন আদালত ও বিচার ব্যবস্থার সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন বর্তমানে দেশের আইন আদালত গুলোর মূল কাঠামো ধসে পড়েছে।

 

 

তিনি বিচারকদের 'ঐশ্বরিক আত্মা' অভিহিত করে বেদনার সাথে বলেন এখন এই ঐশ্বরিক আত্মার উপর মানুষের আস্থা বিশ্বাস নড় বড়ে হয়ে পড়েছে। আদালত বিচারকদের উপর মানুষের আস্থা না থাকলে তার কাঠামো টিকে থাকতে পারেনা ধসে পড়ে। তিনি কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেছেন আমাদের দেশে এখন অদৃশ্য ইঙ্গিতে আদালতের রায় দেওয়া হয়।

 

 

তিনি বলেন এক বয়স্কা সম্মানিত মহিলা কে (বেগম খালেদা জিয়া) নিম্ন আদালত পাঁচ ৫ বছরের সাজা দেয় । কিন্তু আপিলে উচ্চ আদালত তার সাজা বাড়িয়ে দশ বছর করে দিল। তাকে জামিনও দেওয়া যাবে না। অথচ খুনের মামলার আসামি জামিন পায়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী খালাস পায়।

 

 

যে মামলায় তাকে এই সাজা দেওয়া হয়েছে- তা ছিল পদ্ধতিগত ভুলের কারণে এক অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য একাউন্টে ট্রান্সফার হয়ে । এখন সুদাসলে দুই কোটি টাকার জায়গায় ছয় কোটি টাকা হয়েছে - এবং মোট টাকার একটি টাকাও তসরুপ হয়নি।

 

 

অথচ এমনই একটি মামলায় সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে সাজা দেওয়া হলো। এতে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে এই রাষ্ট্রে আইনের চোখে সবাই সমান নয়। এখন মনে হয় দেশের আইন আদালত যেন কেবলমাত্র বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমনের হাতিয়ারের পরিণত হয়েছে।

 


একজন বিচারকের প্রধান কাজ হচ্ছে দেশের সংবিধান বিদ্যমান প্রচলিত আইন অনুযায়ী দ্বিধাহীন চিত্তে ন্যায় বিচারের মাধ্যমে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা। এক্ষেত্রে বিচারকদের ঊর্ধ্বতন কারো নির্দেশে বা অনুরোধে কোন ধরনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ নেই।

 

 

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে যারা উচ্চ আদালতের বিচারক হিসাবে নিয়োজিত তাদের অধিকাংশই এক সময় আইনজীবী হিসাবে আইন পেশার সাথে জড়িত ছিলেন।

 

 

কিন্তু তারা যখন মেধা নয় রাজনৈতিক বিবেচনায় উচ্চ আদালতের বিচারক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন তখন এ সমস্ত বিচারকগণ বিচার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে প্রায়শই নিজেদের বিশ্বস্ত রাজনৈতিক দলের প্রভাব মুক্ত থাকতে পারেন না। আর এক্ষেত্রে বিচার ফয়সালায় অন্যায় ও অনৈতিক প্রাপ্তি - সংযোগটাও একেবারে অসম্ভব নয়।

 

 

আমাদের দেশে এখন কতিপয় বিচারপতি রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। একজন বলেছেন- আমরা শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ অন্য আরেকজন বলেছেন এ দেশটা রাজাকারদের বসবাসের জন্য নয়।

 

 

প্রশ্ন জাগে মাননীয় বিচারপতিদের এসব বক্তব্য বাংলাদেশের সংবিধানের কোথায় কত ধারায়, অথবা দেশের প্রচলিত আইনের কোথায় কিংবা বিচারকদের আচরণবিধির কোথায় তা লিপিবদ্ধ আছে? দেশের বর্তমান সংবিধান আইনের শাসন ন্যায় বিচার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ তুলে ধরাই একজন বিচারপতির প্রধান দায়িত্ব।

 

 

এ ব্যাপারে গত ৩১শে আগস্ট ২৩ ইং তারিখে দেশের বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তার বিদায়ী ভাষনে বলেছেন বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থাকতে হবে।

 

 

তা না হলে দেশের মানুষ বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগের প্রতি আস্থা হারালে এই জাতিকে খারাপ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তিনি আরো বলেন একজন বিচারপতিকে ভাবতে হবে দেশের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ন্যায় বিচারের কথা।

 


এ ব্যাপারে কিছুদিন আগের থাইল্যান্ডের এক বিচারকের কথা উল্লেখ করা যায়। গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে আইন সংগতভাবে সাক্ষ্য প্রমানে ভিত্তিতে বিচার ফয়সালা করতে গিয়ে সহযোগী বিচারক ও উচ্চ আদালতের চাপে আসামিদের সাজা দিতে বিবেকের চাপে অপারগ হয়ে থাইল্যান্ডের বিচারক কানাকর্ন পিয়ানচানা অবশেষে নিজের বুকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।

 

 

বিচারক কানার্কন গুলী চালানোর আগে ২৫ পৃষ্ঠার একটি বিবৃতিতে তার কারণ সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। জানা যায় বিচারক কানার্কন যে মামলার শুনানি করেছিলেন তা ছিল জাতীয় নিরাপত্তা গোপন ষড়যন্ত্র ও সাথে অবৈধ অস্ত্র রাখার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তিনি দাবি করেন এ গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আসামিদের সাজা প্রদান করতে গিয়ে তার সাথে জোষ্ঠ বিচারকদের মতানৈক্য দেখা দেয়।

 

 

তার মতে মামলার আসামিদের সাজাপ্রধানের জন্য সন্দেহাতীতভাবে সাক্ষ্য প্রমাণের ঘাটতে ছিল। তিনি মামলার পাঁচজন অভিযুক্তকেই খালাস দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জোষ্ঠ বিচারকরা তাকে ডেকে নিয়ে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড বাকি দুইজন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিতে চাপ প্রয়োগ করেন।

 


বিবৃতিতে তিনি আরো দাবি করেন এই মুহূর্তে অন্যান্য অধঃস্থন বিচারকদের সাথে একই আচরণ করা হয়েছে। তিনি লেখেন এমতবস্থায় একজন বিচারক হিসেবে। বিবেকের তাড়নায় ন্যায় বিচারের স্বার্থে এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে - একজন ন্যায় বিচারক হিসেবে আমার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই শ্রেয় "।

 

 

থাইল্যান্ডের বিচার বিভাগ ও বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে বেশ অভিযোগ রয়েছে।দেশটির আদালতের রায় বেশির ভাগই বিত্তবান ও প্রভাবশালীদের পক্ষে যায়। অন্যদিকে ছোট অপরাধে সাধারণ মানুষকে গুরু দণ্ড দেওয়া হয়।

 

 

বিচারালয়ে এহেন প্রহসনের বিচারে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এমনকি অনেকে মিথ্যা অভিযোগের দ্বায়ভার মাথায় নিয়ে অনেক নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে যেতও হয়। এ কাজে অনেক সময় বিচারকরা ক্ষমতাবানদের দ্বারা অনেকটা প্রভাবিত থাকেন প্রায়শই।

 


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব অঙ্গরাজ্য হেরেছেন সেখানে নির্বাচনে অনিয়ম ও ভোটে কারচুপির মাধ্যমে তাকে হারিয়ে দিয়েছে এ অভিযোগ করে ট্রাম্প ৬৩ টি মামলা দায়ের করেছিলেন । আর অধিকাংশ আদালতের বিচারক ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত ও পচ্ছন্দনীয় ব্যক্তি।

 

 

অথচ আমেরিকার জাতীয় স্বার্থে একজন বিচারক হিসেবে ন্যায় ও সত্যের স্বার্থে কোন বিচারকই ট্রাম্পের পক্ষে রায় দেননি। তারা মূলত দেশের সংবিধান আইন ও আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার জন্য নিরপেক্ষ রায় দিয়েছিলেন।

 


তারা যদি ট্রাম্পের ভিত্তিহীন অভিযোগের পক্ষে অনুরাগ বিরাগে আচ্ছন্ন হয়ে রায় দিতেন তাহলে মার্কিন গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিচারহীনতার একটি কালো অধ্যায় রচিত হত।  রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিচার ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, দেশে নিপীড়িত নির্যাতিত মজলুম মানুষের শেষ ভরসা স্থল হচ্ছে আদালত।

 

 

দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব থাকে বিচার বিভাগের উপর বিচার বিভাগ ও বিচারকগণ যদি স্বাধীন না হয় বিচারক যদি অনুরাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে ওঠে ন্যায় বিচারক না হন তাহলে দেশের প্রভাব শালী ব্যক্তি দেশের রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অপরাধের বিচারের রায় প্রধানের ক্ষমতা কোন বিচারকেরই থাকেনা।

 

 

দার্শনিক সক্রেটিস কে যারা প্রহসনের বিচারের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন সক্রেটিসের মৃত্যুর পর পরেই সেইসব রাজতোষক বিচারকদের কেউই জনরোষে করুন পরিনীতি থেকে রক্ষা পায়নি। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এথেন্সে যে আদালত সক্রটিস কে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল কিছুদিন আগে সেই আদালতেই তার মরণোত্তর বিচারের রায়ে সক্রেটিস ছিলেন নিরপরাধ ও নির্দোষ।

 


মহানবী সাঃ বলেছেন তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো নিরপেক্ষ বিচারের অভাবে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বড়লোকেরা অন্যায় করলে তাদেরকে নাম মাত্র বিচার করে ছেড়ে দেওয়া হতো। অথচ একই অপরাধে গরিবের উপর নেমে আসতো কঠোর শাস্তি। এ কারণেই বনি ইসরাইল জাতি দুনিয়া থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে।  

 

 

ভারতের কংগ্রেস নেতা ও নেহেরু মন্ত্রিসভার তরুণ সদস্য বিখ্যাত মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার এক লেখায় বলেছেন ময়দান- ই- জং (যুদ্ধের ময়দান) এরপর পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপেক্ষা বড় অন্যায় ও অবিচার আদালতের কোঠায় সংগঠিত হয়েছে।   এন. হুসেইন রনী  /জেসি
লেখক আইনজীবী /সাংবাদিক   

এই বিভাগের আরো খবর