শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বাড়ছে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, বাড়ছে উদ্বেগ

মো.মোমিনুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৭ জুন ২০২১  

নারায়ণগঞ্জে আতঙ্কের আরেক নাম সংঘবদ্ধ ধর্ষণ। প্রতিনিয়তই বাড়ছে এমন ঘৃণ্য অপরাধের সংখ্যা। জেলা পুলিশের একটি সূত্রে জানা গেছে, বিগত দুই মাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণের ঘটনায় জেলা জুড়ে ৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। শুরুতে বিষয়গুলো বিচ্ছিন্ন মনে হলেও ধর্ষণের এই মহামারীতে দলবদ্ধ ধর্ষণ এখন প্রতিনিয়তই সংঘটিত হচ্ছে।

 

নারীকে দূর্বল ভেবে একদল পুরুষ নিজেদের যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য এইরূপ কর্মকান্ড করে বেড়াচ্ছে, বলছেন বিশিষ্টজনরা। তাদের দাবী কঠোর দৃষ্টান্ত কিংবা আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় জেলা জুড়ে ধর্ষণপ্রবণতার অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাদের অভিযোগ এমন অপরাধ করার পরও কথিত ধর্ষকরা খুব সহজেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে, যা পরবর্তীতে ভূক্তভোগী পরিবারদের বাধ্য করছে মামলা তুলে নিতে অথবা মিমাংসার রাস্তায় হাঁটতে।


 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শুক্রবার (৪ জুন) নগরীর নীমতলি এলাকায় ২৮ বছর বয়সী দুই সন্তানের এক জননীকে কাজের কথা বলে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে ওই এলাকার মিঠু চন্দ্র দাস ও হাবু চন্দ্র সুত্রধর নামের দুই ব্যক্তি।  ভূক্তভোগী নারী সদর মডেল থানায় অপরাধের বর্ণনা করে অভিযোগ দিলেও কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মকর্তা ধর্ষকদের সাথে আপোষ মিমাংসার প্রস্তাব দিয়েছেন এমন অভিযোগ ওই নারীরর। এরপর পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে সদর পুলিশ অভিযোগটি আমলে নিয়ে মামলা হিসেবে রেকর্ড করে এবং অভিযুক্ত ধর্ষক মিঠু চন্দ্র দাস ও হাবু চন্দ্র সুত্রধরকে গ্রেপ্তার করে।


 
অপরদিকে, গত আড়াই মাস আগে (৬ এপ্রিল) ১৫ বছর বয়সী এক তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে নিহত তরুণীর বড় ভাই মো. মাহফুজুর রহমান (২৩) বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলার সূত্রে জানা গেছে, মামলা দায়েরের পাঁচ দিনে আগে চাঁদপুর উত্তর মতলব জোড়খালী এলাকার মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী আমেনাকে অপহরণ করে সিদ্ধিরগঞ্জে নিয়ে আসে প্রতিবেশী রিয়াদ আব্দুল্লাহ ও মো. শহিদুল ইসলামসহ অজ্ঞাতনামা তরুণারা। এরপর দলবদ্ধ ধর্ষণ করে আশংকাজনক অবস্থায় ওই তরুণীকে ফেলে পালিয়ে যায় তারা।

 

স্থানীয়রা নির্যাতনের শিকার কিশোরীকে অসুস্থ্যবাস্থয় প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জের মা হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলে ওইদিন রাত পৌন ১০টায় চিকিৎসকরা আমেনাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই দিকে চাঞ্চল্যকর এই গণধর্ষণ ও হত্যা মামলার আড়াই মাস অতিবাহিত হলেও এখনো পর্যন্ত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শফিকুল ইসলাম যুগের চিন্তাকে জানিয়েছেন, অভিযুক্ত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তিনি জানিয়েছেন, ময়না তদন্ত রিপোর্ট ও ডিএনএ পরীক্ষার মতামত পাওয়ার পর তরুণীর মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।
 

খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, তিন মাসের অন্তঃসত্বা প্রতিবন্ধী এক নারীর ভাই এপ্রিল মাসের ১ তারিখ ফতুল্লা মডেল থানায় গণধর্ষণের অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই ব্যক্তি মামলার এজাহারে জানিয়েছেন, ফতুল্লার চিতাশাল এলাকার খলিলুর রহমান (৪২) ও মো. রাসেল (৪৩) নামের দুই ব্যক্তি দীর্ঘদিন বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তার প্রতিবন্ধী বোনকে ধর্ষণ করে আসছিল, যার কারণে তার তিন মাসের অন্তঃসত্ত¡া হয়ে পড়ে। এদিকে মামলার দুই মাস অতিবাহিত হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

 

ভূক্তভোগী প্রতিবন্ধী নারীর ভাই জানিয়েছে, এতদিন হয়ে গলেও পুলিশ কেন আসামীদের গ্রেপ্তার করতে পারছেনা সেটা তার জানা নেই, তবে তার পরিবার সার্বক্ষণিক থানার সাথে যোগাযোগ করে চলছেন, পরিবারের দাবী আইন ওই দুই ব্যক্তির বিচার করবে। অপর দিকে ওই নারীর ধর্ষণ সংক্রান্ত ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্যাতনের শিকার তরুণীর গর্ভপাত করানো হয়েছে। বিষয়টি জানার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) মো. তরিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায় নি।


 
গত মাসের ৯ তারিখ রাত সাড়ে ৯টায় ২৬ বছর বয়সী এক গার্মেন্টস শ্রমিক বন্দরের কেওঢালা এলাকার রুহুল আমিনে বাড়ীতে থাকার জন্য একটি কক্ষ ভাড়া নেয় এবং রাত ১০ টায় ভাড়া নেওয়া কক্ষে থাকার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করার সময় বাড়ীওয়ালা রুহুল আমিনের ছেলে লিমন (২৬), শাহ আলম (২৮)সহ আরো দুই জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ওই নারীর কক্ষে প্রবেশ করে তাকে উত্ত্যক্ত করলে সে পাশের আরেক ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। দিবাগত রাত দুই টার সময় বাড়ীওয়ালার ছেলেসহ তার সহযোগীরা গার্মেন্টস শ্রমিক নারীকে তার ঘর থেকে জোর করে বরে পার্শ্ববর্তী একটি জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে মারধর করে তার মুখ চেপে ধরে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে।

 

এই ঘটনায় ভূক্তভোগী ওই নারী বাদী হয়ে বাড়ীওয়ালা রুহুল আমিনের ছেলে লিমন, শাহ আলমসহ আরো দুই জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বন্দর থানায় নির্যাতন ও গণধর্ষণের মামলা দয়ের করেন। এদিকে মামলার এক মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও গণধর্ষণের মূল হোতা বাড়ীওয়ালা রুহুল আমিনের ছেলে লিমন ও তাদের ড্রাইভার শাহ আলমকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) মো. সুজন হক জানিয়েছেন, ঘটনায় জড়িত সন্দেহে জাকির (৪০) নামে এক আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অপরাপর আসামীদের গ্রেপ্তারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।


 
রূপগঞ্জের গঙ্গানগর এলাকায় চার মাসের অন্তঃসত্ত¡া এক গৃহবধূকে অপহরণ করে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে স্থানীয় বাবুল মিয়া (৪০), আমির হোসেন (৩৪) ও লিটন (৩৫) নামের তিন ব্যক্তি। ভূক্তভোগী গৃবধূর স্বামী পেশায় একজন রাজ মিস্ত্রী। গত মার্চ মাসের ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় ওই গৃহবধু ঘরের কাঁচা তরকারী কেনার জন্য বাহিরে গেলে অভিযুক্ত বাবুল, আমির ও লিটন গৃবধুর মুখ চেপে ধরে একটি অটোযোগে অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং নৌকা যোগে একটি নদী পাড় হয়ে নির্জন মরিচ ক্ষেতে নিয়ে গিয়ে ওই নারীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে হত্যার হুমকি দেয় অভিযুক্তরা পালিয়ে যায়।

 

পরবর্তীতে ওই নারী গুরুতর অসুস্থাবস্থায় তার স্বামীকে ফোন করে সংবাদ দিলে গৃহবধুর স্বামী তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে এবং এই ঘটনার সাত দিন পর ভুক্তভোগী গৃহবধুর স্বামী বাদী হয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) মো. হযরত আলী জানিয়েছেন, মামলা দায়েরের পর আসামী বাবুল মিয়া ও আমির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হলে গত কয়েকদিন পূর্বে দুইজনই জামিনে মুক্তি লাভ করেছে এবং মামলার বাদী বর্তমানে রূপগঞ্জে থাকেননা, বাদী ও আসামীদের মধ্যে আপোষ হয়ে থাকতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।


 
থানা সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও ধাপে ধাপে প্রতিকূলতার জালে জড়িয়ে পড়ছে বিচার প্রাপ্তির আশা। ভয়-ভীতি অথবা অর্থের বিনিময়ে বাদী পক্ষের সঙ্গে মীমাংসা করে মামলা দুর্বল করে ফেলা হয়। সাক্ষী উধাও হওয়ার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ধর্ষণের মামলা। ধর্ষণের ঘটনা বাড়লেও সাজা পাওয়ার সংখ্যাও খুব বেশি নয়। ধর্ষকদের মধ্যে অপরাধবোধ কিংবা অনুতপ্ত হওয়ার ঘটনার উদাহরণও বিরল। আর অপরাধ করেও অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা।  

এই বিভাগের আরো খবর