শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মুজিবই শক্তি, মুজিবই সত্য

করীম রেজা

প্রকাশিত: ১১ আগস্ট ২০২২  


# মুক্তিযুদ্ধে  বঙ্গবন্ধুর অদৃশ্য উপস্থিতি সর্বদাই ছিল

# অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা ছড়িয়ে আছেন দেশজুড়ে

# মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগুলো সংরক্ষণে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

 


বাংলাদেশ  ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর  হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে। চাপিয়ে দেয়া একটি অসম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। সমগ্র বিশ্ব হয় চমকিত। সাধারণ জনযোদ্ধাদের কাছে বিশ্বমানের একটি আধুনিক সামরিক বাহিনীর পরাজয় বিশ্বের সামরিক ইতিহাসে এক বিরলতম ঘটনা। মাত্র নয় মাসে ছোটবড় অনেক ঘটনার যোগফল বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা। 

 


মোটাদাগে স্বাধীনতা নিয়ে অনেক বই-পুস্তক লেখা হয়েছে। এখনও লেখা হচ্ছে, আরো হবে। গবেষণাগ্রন্থও রচিত হয়েছে। ইতিহাস বিজ্ঞানের নিরিখে যথাযথ ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে গুণীজন তা মনে করেন না। তারপরও যা লিখিত হয়েছে বা হচ্ছে তার গুরুত্বও কোনও অংশেই কম নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন অনেক ঘটনার বিবরণ এখনও অলিখিত রয়েছে। ইতিহাস সচেতনতার অভাবে তথ্য-প্রমাণ হারিয়ে যাচ্ছে। 

 


তাছাড়া সরাসরি যুদ্ধে জড়িত যোদ্ধা, সহযোদ্ধা, যুদ্ধে সহায়তাকারী, গণহত্যার চাক্ষুষ সাক্ষী, ভারতে শরণার্থী কিংবা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয়ী বা আশ্রয়দানকারী অনেকেই আজ বয়সের কারণে মৃত বা বিস্মৃতি পীড়িত। তার মানে ইতিহাসের চরিত্রগুলো ক্রমান্বয়ে প্রাকৃতিক নিয়মেই কমে আসছে, হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে উজ্জীবনী শক্তির আধার বঙ্গবন্ধুর যুদ্ধজয়-মন্ত্রের অমোঘতার ইতিহাস।

 


প্রাকৃতিক এই নিয়ম মেনে নিয়েও আমাদের ইতিহাস সন্ধান, সংরক্ষণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। যেহেতু সারাদেশের মানুষ এই যুদ্ধে নানাভাবে সামিল ছিল- কিছু সংখ্যক চিহ্নিত রাজাকার এবং পাক-বাহিনীর দোসর ছাড়া। সেই অকুতোভয় যোদ্ধারা ছড়িয়ে আছেন দেশজুড়ে। দেশের আনাচে কানাচে। তাদেরকে সংগঠিত করা বা নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব। তবে অসম্ভব হলেও কঠিন নয়। 

 


আর এই কঠিন কাজটিই বলা যায় নিজ নিজ দায়িত্বে সাধ্যমত করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম, বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং প্রিন্ট মিডিয়া। কেউ কেউ ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বই পুস্তকও ছাপিয়ে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন। যৌথভাবে কাজ করা, বলা হয়ে থাকে, যে কোনও কাজে অগ্রগতির প্রধান শর্ত সবাই মিলে সেই কাজটিই করা। 

 


মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দালিলিকভাবে সংগৃহীত হচ্ছে; কিন্তু বিচ্ছিন্ন, অসমন্বিত উপায়ে। সংরক্ষণও করছেন সবাই যার যার মত। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মহান গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ সমগ্ররূপে দৃশ্যমান কঠিন হবে। যেমন তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে, যা কোন একটি টিভি চ্যানেলে দেখেছিলাম। 

 


এক - একজন বৃদ্ধা ভিক্ষুক সারাদিন আশপাশের গ্রাম বাজার ঘুরে কিছুই পাননি। কারণ পাকিস্তানিরা সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। লোকজন সবাই বাড়ি ছাড়া, চারদিক জনশূন্য। অগত্যা ফেরার পথে জঙ্গল থেকে কিছু জংলি কচুর মূল তুলে আনেন। মাটির চুলায় হাঁড়ি চাপিয়ে সিদ্ধ করছেন। এমন সময় তার কুড়েঘরের আড়ালে এক দলবিচ্ছিন্ন ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধার চেহারা দেখা যায়। বুড়ি পরম মমতায় তাকে বসতে দেন চুলার পাশে। কিছু খাবার না থাকায় ওই সেদ্ধ কচইু খেতে দেন। নিজের জন্য কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু সেই বুড়ি ছিলেন পরিতৃপ্ত। খাবার শেষে সেই মুক্তিযোদ্ধা বুঝতে পারেন, বুড়ি অভুক্ত থেকে তাকে খাইয়েছেন। 

 


দুই - অন্য ঘটনাটি হল এক বাড়িতে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু সেই বাড়ির কর্তা আসলে পাকিস্তানিদের দোসর তা জানা ছিল না। তার ছেলের বউ এসে মুক্তিদের জানালেন যে,তাদেরকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য তার শ্বশুর পাকিস্তানিদের খবর পাঠিয়েছে। বউটি ছিল নববিবাহিত। পাকিস্তানিরা হামলা করার আগেই মুক্তিরা নিরাপদে সরে যায়। পরে ফিরে এসে দেখতে পায় সেই বধূটি তার শ্বশুরকে বটি দিয়ে দ্বিখন্ডিত করেছেন।

 


তিন - আরেক মা এক মুক্তিসেনাকে বাঁচানোর জন্য তার যুবতী মেয়েকে এক লেপের তলায় রেখে ঘরে শিকল দিয়ে রেখেছিলেন। পাক সেনারা বাড়ি তল্লাশি করে বদ্ধ ঘরে জামাই মেয়েকে এক লেপের তলায় দেখে ফিরে যায়। এভাবে সেই মহিয়সী মা এক আহত মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। নিকট অতীতে দেখা এই প্রচারিত ঘটনাগুলো। দিনক্ষণ জায়গার নাম মনে করতে পারছি না। তবে খুব সম্ভব চ্যানেল আই, এটিএন এবং সময় টিভির আর্কাইভ খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু এসবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের এই ইতিহাসগুলো বিভিন্নভাবে নানান মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। 

 


ইতিহাসের প্রয়োজনে সমন্বিতভাবে এসব ঘটনা এক জায়গায় সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। সঠিক ইতিহাস রচনার জন্য, জাতির মহান গৌরবগাঁথার ধারাবাহিকতা অনুসরণের জন্য সব উপাদান একত্রিত করার প্রচেষ্টা নিতে হবে। এখনই উপযুক্ত সময়। ইতিহাস বিকৃতির নানা আয়োজনের সমুদ্রসমান বাঁধা অতিক্রম করে কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম গণজাগরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে। তারা নিজেরাই স্ব-উদ্যোগে আসল সত্য উদঘাটন করেছে। 

 


সত্য সন্ধানে আমদেরও দায় আছে, তাদেরকে সঠিক পথ দেখানোর এবং সহযোগিতা করার। সব কিছুর আগে মনে রাখতে হবে, পুরো নয় মাস যুদ্ধ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে, কিন্তু তাঁর নামে। তাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি ছিল মুক্তি সংগ্রামে গেরিলা কিংবা সম্মুখ যুদ্ধের মূল চালিকা শক্তি। ৭১ এর নয়মাস মুজিবই ছিল একমাত্র শক্তি, একমাত্র সত্য। লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ। এন.এইচ/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর