শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

আদালতের নির্দেশনার পরও চার্জশিটভুক্ত হয়নি তিতাসের সেই আটজন

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ৩০ মে ২০২১  

তল্লায় মসজিদে গ্যাসের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তিতাসের অভিযুক্ত আট কর্মকর্তা-কর্মচারির বিরুদ্ধে দোষ প্রমাণিত হলেও দীর্ঘ ৫ মাসেও তাদেরকে চার্জশিটে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। মামলার তদন্তকারি সংস্থা সিআইডির নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রধান (এএসপি) হারুন উর রশিদ দৈনিক যুগের চিন্তাকে জানিয়েছেন, তিতাসের অভিযুক্ত আট কর্মকর্তা-কর্মচারিকে চার্জশিটভুক্ত করার জন্য তিতাসের হেডকোয়ার্টারে পরপর দু’দফায় অনুমতি চাইলেও তিতাস কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এখনো অনুমতি মেলেনি।

 

ফলে আদালতে অসম্পুরক চার্জশিট দাখিলের পাঁচ মাস পেড়িয়ে গেলেও ঘটনার জন্য অন্যতম দায়ী তিতাসের অভিযুক্ত সেই আটজনকে যুক্ত করে এখনো সম্পূরক চার্জশিট দেয়া হয়নি। এমনকি আদালতের বিচারকের নির্দেশনার এক মাসেরও বেশি সময় পেড়িয়ে গেলেও এখনো তাদের বিরুদ্ধে সম্পুরক চার্জশিট দেয়া হয়। তা নিয়ে হতাহতদের পরিবার সহ সচেতন মহলে নানামুখি আলোচনা-সমালোচনা চলছে।  জানা গেছে, গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা চামারবাড়ি মসজিদে গ্যাস লিকেজ ও বিদ্যুতের স্পার্ক থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে শিশুসহ ৩৪ জনের প্রাণহানী হয়। আহত হন নারীসহ আরো অনেকেই। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা হলে এর তদন্তের দায়িত্ব পায় নারায়ণগঞ্জ সিআইডি বিভাগ।

 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ইন্সপেক্টর মো. বাবুল হোসেন। তদন্তের ৪ মাসের মাথায় ২০২০ সালের ৩১ অক্টোবর মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুর গফুর, ডিপিডিসির মিটার রিডার ও স্থানীয় বৈদ্যুতিক টেকনিশিয়ানকেসহ মোট ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত তিতাস গ্যাসের আটজন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছিলো সিআইডি।

 


তিতাসের ওই আট কর্মকর্তা হলেন, তিতাস গ্যাস ফতুল্লা আঞ্চলিক অফিসের বরখাস্ত হওয়া ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম (৪২), উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মাহমুদুর রহমান রাব্বী (৩৪), সহকারী প্রকৌশলী মানিক মিয়া (৩৩), সহকারী প্রকৌশলী এস এম হাসান শাহরিয়ার (৩২), সিনিয়র সুপারভাইজার মনিবুর রহমান চৌধুরী (৫৬), সিনিয়র উন্নয়নকারী মো. আইউব আলী (৫৮), সাহায্যকারী হানিফ মিয়া (৪৮) ও কর্মচারী ইসমাইল প্রধান (৪৯)।

 

ইতিপূর্বে ওই আটজনই গ্রেফতার হয় এবং তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। তাদের তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছিলো তিতাস কর্তৃপক্ষ। তবে, বিস্ফোরণের বিষয়ে তিতাসের পক্ষ থেকে গঠিত দুটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, দূর্ঘটনায় তিতাসের কারো অবহেলা নেই। অতঃপর গত গত বছরের ৫ অক্টোবর ওই আটজনকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে তিতাস কর্তৃপক্ষ।

 


এই অবস্থায় গত ১১ মার্চ নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাউসার আলমের আদালতে উত্থাপন হয় সিআইডির ওই চার্জশিট। চার্জশিট আমলে নিয়ে মামলাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য পাঠানো হয়। একই সাথে তিতাসের ওই আট জনকে চার্জশিটে অন্তর্ভূক্ত করার নির্দেশ দেন কাউসার আলমের আদালত। আদালতের নির্দেশের প্রেক্ষিতে তিতাসে দ্বিতীয় বারের মত আবেদন করে সিআইডি কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয় দফায় করা ওই আবেদনের প্রায় ৮৫ দিন পেড়িয়ে গেলেও এখনো তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা আসেনি। সব মিলিয়ে অসম্পুরক চার্জশিটের পাঁচ মাস পেড়িয়ে গেলেও এখনো তাদের যুক্ত করে সম্পুরক চার্জশিট দেয়া হয়নি। এই বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সিআইডি কার্যালয়ের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হারুন অর রশিদ দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘তিতাসের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে আমরা অনুমতিপত্র চেয়ে আবেদন করেছি। কিন্তু এখনো সেনশন হয়নি। কোন নির্দেশনা এখনো পাইনি। নির্দেশনা পেলে অবশ্যই তাদেরকে চার্জশিটভুক্ত করা হবে।’

 


নির্দেশনা আসায় বিলম্ব হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চার্জশিট জমা দেয়ার আগেও তাদের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছি, আবার চার্জশিট আদালতে দাখিলের পর বিজ্ঞ বিচারক এর আদেশের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় বারের মত তিতাসের অনুমতি চেয়েছি। কিন্তু এখনো কোন অনুমতি পাইনি। বিলম্ব হাওয়ার কারণ তিতাস কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন।’ এদিকে, তিতাসের হেড অফিসের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি। তাই বিলম্ব হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিতাসের পক্ষ থেকে কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে, রহস্যের দানা বেধেছে জনমনে। অনেকেই বলছেন, তিতাসের অভিযুক্ত ৮জনকে মামলা থেকে আড়াল করার সু² প্রচেষ্টা চলছে। তাই অনুমতির অযুহাত চলছে।


এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহবায়ক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেছিলেন, ‘আমরা যেই বিষয়টি লক্ষ করছি, তা হলো এসকল সরকারী সংস্থাগুলো কাউকে কাউকে রক্ষা করার জন্য আইনের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। এতে অপরাধি যারা, তারা যেমন পার পাচ্ছে, পাশাপাশি এই সকল অপরাধিরা আরো উৎসাহিত হচ্ছে। তল্লা মসজিদের বিস্ফোরণে নেপথ্যে সংশ্লিষ্ট তিতাস কর্মকর্তা কর্মচারিদের প্রচন্ড গাফলতি রয়েছে। এটি জানার পরও তাদের পক্ষে এমন নগ্ন ভাবে পক্ষাবলম্বন করাটা জনগণের কাছে বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। আর সরকারের এই সংস্থাগুলো যে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পারে না, এটা তারই প্রমান। অপরাধীকে অপরাধী করার জন্য কার অনুমতি লাগবে! তাহলে তারা (সিআইডি) তদন্ত করতে গেলো কেন? তারা আগেই বলতো যে, আমরা তদন্ত করতে পারবো না। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে বলা বা তুলে ধরার যোগ্যতা যাদের নেই, তারা তদন্ত করে কেন।’  


নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছিলেন, ‘এটি একটি প্রহসন। আমরা মনে করি, বিস্ফোরণের পেছনে তিতাসেরই দ্বায় বেশি। অথচ, সেই তিতাসের কর্মকর্তাদের বাদ রেখে অসম্পূর্ণ একটি চার্জশিট দেয়া হলো। এই চার্জশিট জনগণ বা আমরা বিশ্বাস করি না। এখানে সু²ভাবে একটা গড়িমশি করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে অনুমতি পেতে এতো দীর্ঘদিন বিলম্ব হওয়ার কথা নয়। তিতাসের অভিযুক্তরা সরকারের নিজস্ব লোক হওয়ায় এটা নিয়ে গড়িমশি করছে। আমার ধারণা, তাদেরকে মামলা থেকে আড়াল করার জন্য এটি করা হচ্ছে।’
 

এই বিভাগের আরো খবর