রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুতে আস্থা কমছে ডাক্তারদের উপর

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৯ মার্চ ২০২৪  

 

নারায়ণগঞ্জে ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসকের অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে নগরীতে গত ১৫ দিনে টনসিল অপারেশনে ভুল চিকিৎসায় কয়েকজন রোগীর মৃত্যুর ঘটনা শহর জুরে আলোচনার ঝড় উঠেছে। ফাটল ধরেছে রোগী-চিকিৎসকের মধ্যকার সম্পর্কের। রোগীরা আস্থা হারাচ্ছে চিকিৎসকদের ওপর। তাদের সাথে সেবা দেয়া নার্সদেরও দায়ী করা হচ্ছে। এছাড়া হসপিটাল ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক পক্ষের ব্যর্থতা এড়াতে পারে না।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগে চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে রোগী। এতে দেশেরও বদনাম হচ্ছে। এমন ঘটতে থাকলে চিকিৎসার জন্য মানুষ অসহায় হয়ে পরছে। এসব ঘটনায় অভিজ্ঞ টিম দিয়ে কমিটি করে তদন্ত করে দেখতে হবে।

 

এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলায় অর্ধকোটি বেশি জনসংখ্যার বসবাস। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবার জন্য সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে যত্রতত্র বৈধ ও অবৈধ ভাবে ঝুঁকি নিয়ে গড়ে উঠছে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল ক্লিনিক। সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে কিছু প্রতিষ্ঠানে সেবার পরিবর্তে মূলত বানিজ্য চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

প্রতিনিয়ত চিকিৎসার নামে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আর অপচিকিৎসার কারণে মৃত্যুর তালিকা হচ্ছে দীর্ঘ। কিন্তু প্রতিকার খুব কমই পাচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবার। আর এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বেতনভুক্ত ‘দালালরা’ সরকারি হাসপাতালের রোগীদের ভাগিয়ে নিচ্ছে। তার বিনিময়ে তারা পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে।

অপরদিকে কর্মরত ডাক্তারদের কমিশন বানিজ্যের শেষ নেই। কখনো ঔষধ কোম্পানি থেকে কমিশন আবার কখনো ক্লিনিক হসপিটাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী ভর্তি করে কমিশন নিয়ে থাকেন ডাক্তাররা। অভিযোগ রয়েছে ডাক্তার নামক মানব সেবা এখন কসাই হয়ে গেছে।

 

কেননা ডাক্তাররা রোগীদের থেকে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার মাধ্যমে কসাইয়ের মত করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। আবার তাদের ভুল চিকিৎসার জন্য অনেককে প্রাণ দিতে হচ্ছে। কিন্তু এতে করে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বরং তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। তারই বাস্তব চিত্র নারায়ণগঞ্জে কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে উঠে এসেছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরের আল-হেরা জেনারেল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মো. মোস্তাকিম (৮) নামে এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। টনসিলের অপারেশনের পর তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার রুমে (ওটি) শিশুটির লাশ পড়ে থাকতে দেখে জাতীয় জরুরি সেবার ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়। পরে সদর থানা পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। মোস্তাকিম সদর উপজেলার বক্তাবলীর মধ্যনগর এলাকার রমজান আলীর ছেলে।

 

৯ মার্চ বিকালে মোস্তাকিমকে আল-হেরা জেনারেল হাসপাতালে সন্ধ্যায় তার টনসিল অপারেশন করান চিকিৎসক ডা.অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন। পরে ভুল চিকিৎসায় ছেলের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে বাবা রমজান আলী বলেন, ‘আল-হেরা হাসপাতালের চিকিৎসক ডাক্তার অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন আমার ছেলের টনসিলের অপারেশন করেছেন। পরের দিন সকাল পর্যন্ত কোনও খোঁজ খবর না পেয়ে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে দেখি ছেলের লাশ পড়ে আছে। এ সময় হাসপাতালে কোনও চিকিৎসক-নার্সকে খুঁজে পাইনি। ভুল চিকিৎসায় আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। আমি এর সঠিক বিচার চাই।

 

এই ঘটনার আলোচনার মাঝে ২৪ মার্চ শহরের প্রভাবশালী মালিকপক্ষের সিলভার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভুল চিকিৎসার অভিযোগে এক গৃহবধুর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় কর্মরত ডাক্তার সহ ২ জন নার্সকে আটক করা হয়। একই সাথে হাসপাতালের ম্যানাজারকে আটক করা হয়। স্বজনরা জানান মৃত আনিকা সদর উপজেলার ফতুল্লার নয়াবাজার এলাকার রোমান মিয়ার স্ত্রী। নিহত গৃহবধুকে ডাক্তার ও সহকারী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুনের তত্ত্বাবধানে টনসিলের অপারেশনের জন্য ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয় আনিকাকে।

 

অপারেশন শেষে ভোরে তার জ্ঞান ফিরলে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসক তাকে ইনজেকশন পুশ করার পর তার মৃত্যু হয়। পরে মরদেহ রেখে ডাক্তার, নার্সসহ হাসপাতালে সবাই পালিয়ে যায়। চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারে দাবি পরিবারের।

 

এই দুই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ফতুল্লার প্রো-এক্টিভ হাসপাতালে গতকাল ভুল চিকিসায় সাংবাদিক আতাউর রহমানের আতার বোন মারা গেছে বলে অভিযোগ। আতাউর রহমান আতা অভিযোগ করে বলেন, প্রো এক্টিভ হসপিটালে কোন চিকিৎসা করা হয় না। তারা মানুষকে মারার জন্য ব্যবসা খুলে বসেছে।

 

ভুক্তভোগির অভিযোগ ১৮ দিনের ব্যবধানে একই ডাক্তারের মাধ্যমে টনিসলের অপারেশনে ভুল চিকিৎসায় দুজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই ঘটনায় ডাক্তারের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় মানুষের মাঝে ক্ষোভ জমে উঠেছে। এছাড়া সচেতন মহল প্রশ্ন তুলেন আর কতজনের প্রান গেলে স্বাস্থ্য বিভাগ ডাক্তারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবে।

 

তাছাড়া যখন কোন প্রতিষ্ঠানে হতাহতের ঘটনা ঘটে তখন ক্লিনিক হসপিটাল, ডায়গনস্টিক সেন্টারে কাগজপত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠে অথচ স্বাস্থ্য বিভাগ সিভিল সার্জনের তদারকির করার কথা থাকলেও তিনি যেন ঘুমের রাজ্যে থাকেন। প্রতিষ্ঠান সহ কর্মরত ডাক্তারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানান ভুক্তভোগী পরিবারের মানুষ।

 

এই বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার মশিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এস.এ/জেসি

এই বিভাগের আরো খবর