শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ইউনিয়ন নির্বাচন নিয়ে মানুষের ভাবনা

যুগের চিন্তা অনলাইন

প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১  

দেশের সাধারণ মানুষের নিকট ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন একটি উৎসবমুখর ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ তাদের সবচেয়ে কাছের নেতা নির্বাচিত করে থাকেন। যারা তাদের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা পাশে থেকে ভাগ করে নেবেন। একটা সময় ছিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা সদস্য নির্বাচিত করতেন এমন সব মানুষকে যাদের নীতি-নৈতিকতা, বিচক্ষণতা ও সামাজিক জ্ঞান এত প্রখর ছিল যে, মানুষ তাদেরকে জোর করে তাদের প্রতিনিধি বানাতেন। তারাও সততা ও ন্যায় নিষ্ঠতা দিয়ে সাধারণ মানুষের সেই আস্থার প্রতিদান দিতেন।



সময় বদলেছে সেই সাথে বদলে গেছে সামাজিক কিছু নিয়ম কানুন। এখন সবকিছুকে ছাপিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থা ও লেজুড়বৃত্তি হয়ে গেছে নেতা হওয়ার সবচেয়ে বড় নিয়ামক শক্তি, যে কারো টাকা আছে তো সে নেতাদের খুব কাছের লোক আর নেতাদের কাছের লোকটি নেতা হবে না এটা কি করে হয়! তাই কেউ চেয়ারম্যান কেউ সদস্য কেউ তাদের ব্যক্তিগত পছন্দের লোক, এভাবেই তো একটা পদ্ধতিতে চলে এসেছে সবকিছু। সাধারণ মানুষের এখন কোন গুরুত্ব অথবা অবদান একেবারেই নেই বললেই চলে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় আসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ও দেশের সর্বস্তরের মানুষের (গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া) এই পদ্ধতি থেকে কোন ফায়দা হয়েছে কিনা সেটা একমাত্র সময়ই বলে দেবে।

 

সরকারের সুদুরপ্রসারি অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে রূপরেখা, তা বাস্তবায়ন করতে বর্তমান পদ্ধতি কতটা কার্যকর তা অনুধাবন করতে না পারলে হয়তো এক সময় সরকারের পুরো অর্থনৈতিক পরিকল্পনাটি বুমেরাং হয়ে যাবে। দল (আওয়ামী লীগ) থেকে যাবে কিন্তু দলটি সরকারে থাকবে কিনা এটা কিন্তু নিশ্চিত নয়, আর দীর্ঘ সময় সরকারে থাকা অবস্থায় যদি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে না পারে তাহলে সেই দলের ভবিষ্যৎ খুব একটা ভালো হওয়ার কথা নয়।

 

আলীরটেক আওয়ামীলীগ নেতা মাসুম সরকার জানান, দীর্ঘদিন একটানা ক্ষমতায় থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিয়ে দলের কেন্দ্রের সাথে একেবারে তৃণমূলের সাধারণ মানুষের একটা মসৃণ পথ তৈরি করার সুযোগ ছিল কিন্তু সেটা না করে সারা বাংলাদেশে এই নির্বাচন দিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করা হয়েছে বলে দলীয় নেতাদের অভিযোগ। দলের ত্যাগীদের রেখে ভাড়াটিয়া ও বসন্তের কোকিল এনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যার কারণে বিভিন্ন ইউনিয়নের তৃণমূলে দল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। প্রতীক ছিল নৌকা কিন্তু সারা বাংলাদেশে নৌকা প্রতীকের যেসব প্রার্থীরা ছিলেন তাদের অন্তরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল কিনা, তারা আওয়ামী লীগের কর্মী ছিল কিনা, তাদের থেকে দল কতটুকু লাভবান হয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ভবিষ্যতে দলের দুঃসময়ে তারা কতটা পাশে থাকবে সেটা একমাত্র সময়ই বলে দেবে।

 

এদিকে সারা দেশে এসব নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপ সাধারণ মানুষের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে প্রার্থীদের কাছে। নেতাদের অনুকম্পা পেতে মনোনয়নের জন্য সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভালোবাসাকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি, এটা গণতন্ত্রের জন্য যেমন হুমকি তেমনি দলের জন্যও এক অশনী সংকেত। তিনি বলেন, বিগত নির্বাচনের পর সৃষ্ট সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে এবার দলের গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ ২৮(৩)(ঙ) অনুযায়ী আগ্রহী প্রার্থীদের প্যানেল তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ বর্ধিত সভা আয়োজন ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রার্থীদের একটি প্যানেল সুপারিশের জন্য কেন্দ্রে পাঠানোর আহ্বান করা হয়েছিল।

 

জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সইয়ে নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী ওই প্যানেল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, এটা একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু কথা হলো, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া উল্লেখিত সেসব নেতারা কারো না কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করবেন, এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করবেন কিভাবে? কথার  এক পর্যায় এসে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ একেবারেই যে কিছু বুঝে না এমনটি নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও নিজেদের অবস্থান বুঝে অনেক সময় তারা অনেক কিছু বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকেন, কিন্তু তারা অবশ্যই বুঝেন স্থানীয় পর্যায়ে কারা তাদের নেতৃত্ব দিলে সকলের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আর কারা নেতৃত্বে আসলে সমাজের জন্য বিপদজনক হবে।

 

একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য বৃন্দের কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে সমাজের জনগোষ্ঠীর সামাজিক ন্যায়বিচার। শিক্ষা, চিকিৎসা সহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সর্বোপরি তারা সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকেন। একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের সামাজিক ভিত্তি কতটা মজবুত তার উপর। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সামাজিক দৈন্যদশা ও বিশৃঙ্খলা নিয়ে কখনোই সেটা উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। রাষ্ট্রের সেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করে থাকে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা, অন্যান্য সেক্টরের মত যেটা এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আছে।

 

এছাড়া অন্যান্য ইউনিয়নের মানুষ জানান, করোনা মহামারীর সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসকল জনপ্রতিনিধি সরকারি ত্রাণ ও সাহায্য দিতে একচোখা নীতি অবলম্বন করেছেন (বেছে বেছে শুধু নিজেদের স্বজনদের দিয়েছেন) অথবা নিজেরা আত্মসাত করেছেন, দলের নীতি নির্ধারকদের সেসব জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপারে এবার সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আর সর্বসাধারণের সুযোগ এসেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেসব জনপ্রতিনিধিদের চিহ্নিত করে ভোটের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব নির্বাচনে (ইউপি) সরকারের এমপি মন্ত্রীদেরকে বুঝতে হবে যে, সাধারণ মানুষ দলের বিবেচনায় নয় নিজেদের ভালোবাসা, রাগ, ক্ষোভ ও আবেগ অনুভূতি থেকে নেতা (চেয়ারম্যান-সদস্য) নির্বাচন করে থাকেন। এখানে সরকারের বা রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে তৃণমূলে সরকার ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়া ছাড়া আর বিশেষ কোন ফায়দা নেই।

 

সবশেষে একটি কথা বলতে হয় আর তা হল, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা যেন সারাবছর সুখে দুঃখে সাধারণ মানুষের পাশে থাকেন। প্রয়োজনের সময় তাদেরকে পাওয়ার জন্য যেন মানুষকে ঘুরে ঘুরে হয়রান হতে না হয়। তারা যেন সর্বস্তরের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে থাকতে পারেন ও সরকারের অগ্রযাত্রা ও সমৃদ্ধির পথের দিশারী হয়ে মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন। মানুষের আস্থার প্রতিদান যেন তারা দিতে পারেন এই কামনা সর্বস্তরের মানুষের।
 

এই বিভাগের আরো খবর