শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

জ্বালানির জ্বলুনি এবং মলম

করীম রেজা

প্রকাশিত: ৯ আগস্ট ২০২২  

বলা হয় রাতারাতি কোন কিছু হয় না, সবকিছু চাইলেই রাতারাতি পাওয়া যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে তেলের দাম রাতারাতি না হোক, রাতের বেলায় বাড়ে । রাতের বেলা এর আগে বেড়েছে ভোজ্য তেলের দাম । এবার জ্বালানি তেলের দাম। গত শুক্রবার বিইআরসি-র গণশুনানী পাশ কাটিয়ে ৮০ টাকার ডিজেল,কেরোসিনের দাম ১১৪ টাকা করা হয়েছে। ১৩০ টাকার পেট্রোলের আগের দাম ছিল ৮৬ টাকা, ৮৯ টাকার অকটেন হয়েছে ১৩৫ টাকা। দাম বেড়েছে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত।

 


বাংলাদেশে জ্বালানী তেলের দাম এক লাফে প্রায় দেড়গুন, নজিরবিহীন এবং রেকর্ড সৃষ্টিকারী ঘটনা। তেলের তেলেসমাতি বলি আর তেলবাজি বলি, এই অবস্থা থেকে সহজে নিস্তার নাই। দেখা যায়, সারা দেশে দুটিমাত্র পক্ষ আছে। একটি সরকারপক্ষ, আরেকটি মালিকপক্ষ। হতে পারে সে পরিবহন মালিক, দোকান মালিক, মার্কেট মালিক, রিয়েল এস্টেট মালিক, সুপারমার্কেটের মালিক, মিলকারখানার মালিক। এই মালিকরা সরকার পক্ষের সঙ্গে মিলে যা কিছু করেন জনগণের নামেই করেন। তবে স্টিম রোলারের চাকা ওই জনগণের ঘাড়ের উপর দিয়েই চালানো হয়, এ যাবতকাল পর্যন্ত চালানো হচ্ছে। পত্রিকার পাতা থেকে শোনা যাচ্ছে ভোজ্য তেলের দাম আরেকবার বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা তোড়জোড় শুরু করেছে।


 
দেশের সাধারণ মানুষ, যাদের পণ্য-বাণিজ্যের ভাষায় ভোক্তা বলা হয়, তারা দাম বাড়লে বেশ কিছুদিন হৈচৈ সহকারে বিরক্তি প্রকাশ করেন অথবা যন্ত্রণায় আহা উহু জাতীয় শব্দ করেন। সেই শব্দ নীতি নির্ধারকদের কেউ শুনেছে কখনো তেমন ইতিহাসের খোঁজ পাওয়া ভাগ্যের বিষয়। সরকারি চাকরি করেন, রাজনীতি করেন, এমন, এমন, কিছু বড় মাপের লোকজন এইরকম দাম বাড়ার পরিস্থিতিতে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে নানান রকম সুমিষ্ট স্বাদের বাণী বিতরণ করেন। যেই নিদানের সার কথা হল, “সয়ে যাবে”। আর এই ভু-বঙ্গে কে না জানে, সয়ে গেলেই রয়ে যায়। ভোজ্য তেল কিংবা জ্বালানি তেলের বেলায়ও অতীতে তাই হয়েছে, সব সয়ে গেছে। এই বেলাও হয়ত যাবে।

 


ওই মহাজনদের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা হিসেবে কুর্নিশ জানাবার ইচ্ছা কারো কারো হতেই পারে। হস্ত সম্মুখে তাদের পেলে আবার উল্টোটাও যে ঘটবে না বা ঘটতে পারে না, তার নিশ্চয়তাও কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। জনগণের মনের অবস্থার খবর রাখার গরজ কেউ বোধ করে না। কিছুদিন আগে মাননীয় জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন সহনীয় রকমেই তেলের দাম বাড়বে। অর্থাৎ বাড়লেও তা জ্বলনের কারণ হবে না। কার্যত ফল একেবারেই বিপরীত। সরকার দলীয় রাজনীতির রথী মহারথীরা জানাচ্ছেন সরকার তেলের দাম বাড়ায়নি। ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে তেলের দাম বেড়েছে। আবার সরকারি লোকসান কমানোর জন্য তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আছে সীমান্তে তেল চোরা চালান বন্ধের কারণও। পার্শ্ববর্তী দেশে তেলের দাম কম, সেখানে তেল পাচার হয়ে যাবে। এই আশঙ্কা থেকে তেলের দাম বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত বলেই সরকার এবং মালিকপক্ষ মনে করে।


 
 তবে দাম বাড়ানোর এই সুযোগে তেল বিক্রেতা ফোকটে দু চার পয়সা কামিয়ে নিয়েছে। পরিবহন মালিকরাও বাদ যায়নি, তারাও ভাড়া বাড়িয়ে ইচ্ছামত যাত্রীর পকেট কাটছেন। দেখা যাচ্ছে বিশেষ সুবিধা দেয়াও এই দাম বাড়ানোর উদ্যোগের পেছনে কাজ করেছে। আবার দাম বাড়াতে মোটেও সময় লাগে না, কিন্তু পরিবহন ক্ষেত্রের ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিকপক্ষের সময় লাগে এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ। সরকার নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না ঠিকমত।  মাঝখানে ইচ্ছেমত ভাড়া আদায়, ফলাফল-যাত্রীর সঙ্গে  ড্রাইভার-হেল্পারের নিত্য কলহ। 

 


 অন্যদিকে সরকারি কাজে-অকাজে, কত শত অকল্পে-প্রকল্পে কারি কারি কড়ি ভর্তুকি হিসেবে ঢালা হচ্ছে তার হিসাব গৌরী সেনের খাতা পত্রেও লিখে শেষ করা যাবে না। কিন্তু জনগনকে স্বস্তির ভর্তুকি দিতে দেশী-বিদেশী যুক্তির খাড়া দেখানো হয়। আইএমএফের ঋণের শর্তের অজুহাত দেয়া হচ্ছে। এই সেদিন শুরু হওয়া যুদ্ধের কথা ত আছেই। সরকার দলের একজন মান্যগণ্যকে দিয়ে বলানো হল, সরকার নিরুপায় হয়েই দাম বাড়িয়েছে। নিরুপায় সরকারের জন্য জনগণ আহাজারি করতে পারে। পিঠে সাধ্যমত বোঝাও নিতে পারে। তাই বলে ফৌজদারী আইনের আত্মরক্ষার মত যুক্তি দেয়ার আগে একবার বিবেচনা করা দরকার ছিল জনগণ এই বোঝা নিয়ে কতদূর, কতদিন চলতে পারবে। লোডশেডিং-এর নিরুপায়ত্বের সঙ্গে, দৈনন্দিন দ্রব্যমূল্যও এই বেলা যুক্ত করে বিচার করা দরকার।  আসল কথা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমাতে হবে, সরকারি কোষাগারের লাভের অংক বড় করতে হবে। দিনশেষে সরকারও এক রকমের মালিকপক্ষ রূপে ভোক্তার সামনে দাঁড়িয়ে যায় বৈকি।
 মজা হলো, খোদ সরকারই জানাচ্ছে যে, গত এক বছরে দৈনন্দিন খাদ্য পণ্যের দাম বেড়েছে। যেমন চাল ৭৯ শতাংশ,খোলা আটার দাম বেড়েছে ২৪ দশমিক ১৪ শতাংশ, খোলা ময়দার ৩৭.৬৮ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। সয়াবিন ২৮.১১ আর পামওয়েল ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। মসুর ডাল বেড়েছে ৩৯. ২৬ (প্রআ)। এরপরও জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে দেখা যায় রাতের অন্ধকারে। বিশ্বাস করা কঠিন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত কর্তাগণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খতিয়ান অবগত নয়।
আবারও তেল পাচারের সেই গতানুগতিক পুরনো যুক্তি দিয়ে প্রতিবারই দাম বাড়ানো জায়েজ করার চেষ্টা, মানুষ এখন আর বিশ্বাস করে না। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশের সীমান্তে তেল পাচারের ছোট বড় কোন ধরপাকড়ের খবর আজ পর্যন্ত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিতও হয়নি । কোনও কোনও পত্রিকায় এমন অস্বাভাবিক উপায়ে তেলের দাম বাড়িয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির দ্বারা জনগণকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে অতিষ্ঠ করা হচ্ছে বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে। এ সূত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরুর আশঙ্কার সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে। সরকারকে এই সমস্ত অবিমৃশ্যকারী পরামর্শ দিয়ে জনতার বিপরীতে দাড় করানো হচ্ছে বলেও অনেকে ভাবছেন। সরকারের জনবান্ধব পরিচয় এতে করে ফিকে হয়ে আসছে। ঘোলা পানিতে কারা মাছ শিকারে ব্যস্ত তা নজরদারীর মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করা দরকার, সুযোগ হাতছাড়ার আগেই।

 


রুটি-রুজি, অর্থনীতি, চাষবাস, পরিবহনসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে জ্বালানি মূল্যের বৃদ্ধির যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমতে শুরু করেছে তখন বাংলাদেশে দাম বাড়লো। বিশ্ববাজারে দাম কমলে বাংলাদেশে দাম কমানোর নজির নাই। দাম সমন্বয় করার কথা ঢোল টক্কর পিটিয়ে বলা হলেও তা কেউ কখনো দেখেছে, জেনেছে, বলে অনুসন্ধানে পাওয়া যায় না। কিন্তু বিশ্বে যখন তেলের দাম কম ছিল তখন বিপিসি ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে, তাও কিন্তু সাধারণ মানুষের টাকা। মুখে মুখে তাও প্রচার হচ্ছে। সেই টাকা এখন কেন সাধারণ মানুষের কোনও কাজে আসবে না, এই প্রশ্নও ঘুরেফিরে আসছে।

 


কিছুদিন আগেও কর্তাদের মুখে ফেনা উঠতে দেখা গেছে, এই কথা বলায় যে, বাংলাদেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু এখন আর এই বিষয়ে তেমন রা কাড়ছে না কেউ। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সয়াবিন, পানি, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত, ক্ষুদ্র সঞ্চয় সব জায়গাতেই পরিকল্পনার দ্বারা মানুষের কথিত ক্রয় ক্ষমতা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তাহলে বলাই যায় যে, ক্রয় ক্ষমতা কমানোর ক্ষেত্রে অবশেষে লাগাম টানা গেছে। ক্রয় ক্ষমতা বাড়ায় কি কোন ভয়ের জায়গা ছিল? হয়ত ছিল, কেননা আর্থিক ক্রয় ক্ষমতা বেশি হলে মানুষ উদ্বৃত্ত সময় পায় হাতে। রাজনীতি, সমাজনীতি, ন্যায় নীতি, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে ভাবনার, কথা বলার, চর্চা করার সময় পায় তখন। আলোচনায়, কথাবার্তায় তখন ভেতরের শূন্যতা, ফাঁকি, জারি জুরি, যদি কিছু থাকে, সব বের হয়ে পড়ে। অতএব নিদান হিসেবে পিঠে বোঝা চাপাতে হয়। সয়াবিন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে- দিনের পর দিন অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থানে ব্যস্ত রাখতে পারলে আর কোনও দুশ্চিন্তা থাকে না। ক্রয় ক্ষমতা ক্রমশ নিম্নগতি পায়।
তবে শেষ কথা, মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে, একসময় না একসময় তারা ঘুরে দাঁড়াবেই। তখন এই তথাকথিত যুক্তিবাজের দল খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। তাদের দেওয়া সব সুবিধাবাদী যুক্তি জনজলের প্রবল জোয়ারে ভেসে যাবে না, তা আগাম বলা দুষ্কর। মানুষের কল্যাণের জন্যই রাষ্ট্র, কতিপয় আমলা ব্যবসায়ীর সুবিধার জন্য নয়।

এই বিভাগের আরো খবর